দিনটা ভারী বিশ্রী , তারই মধ্যে ডিসেম্বরের রাতে এমন মুশুলধারে বৃষ্টি কলকাতাবাসী আর যাই হোক বিগত দশ বছরে দেখে নি । ভিজে গায়ে সুমন ঘরের তালা খুলে ঢুকলে, বাড়ি ওয়ালা ওপর দিয়ে হাঁক দেয়,
-কে ! কে ওখানে ?
সুমনের একেবারেই মন্দ লাগল না। শীতের রাতে কোন বাড়ি ওয়ালাই বা এভাবে ঘর পাহাড়া দেবে? তাও আবার এমন বৃষ্টিতে ?
ভাবতে ভাবতেই সে বলল,
-মাসিমা আমি! সুমন! চিন্তা করবেন না।
-ও সুমন , আচ্ছা বাবা তুমি এসেছো। তোমার আসতে এত দেরী হচ্ছে তাই একটু চিন্তা করছিলাম আর কি, যাকগে ঘরের দরজা বন্ধ করে দিও । আর রাত বিরেতে বাইরে যেও না। কার টা কার ঘাড়ে চাপে বলা দায়।
সুমনের একেবারেই অদ্ভুত লাগল না ব্যাপারটা বলা ভুল। ভিজে গায়ে বেশি বাইরে দাঁড়ালে বিপদ তাই, সে মাসিমার কথা মতোই ঘরের দরজা এঁটে দিল। এবং খাবারের জোগাড় করতে লাগল। বৃষ্টিটা এখন একটু ধরেছে, তাই সে জানালার পাল্লাটা একটু খুলে দেয়। সারাদিনের বন্ধ হয়ে থাকা ঘরের বেশ বিশ্রী গন্ধ লাগে তার,
তাই সে কিছুক্ষণের জন্যই জানালাটি খুলে রাখে, নিশ্বাসটুকু যাতে নেওয়া যায়। মোবাইলে,
“যখন নীরবে দূরে দাঁড়াও এসে,
যেখানে পথ বেঁকেছে”
গানটি চলছে, তখনও অপেক্ষায় সে তার বন্ধুর।
-আজ বোধহয় আসবে না এই ঠান্ডায় ।
সুমন একা থাকলেও, অনুভব তাকে একা শব্দটা ভাবতেও দেয় না। পাশের পাড়াতেই থাকে সে । প্রতিদিনের রাতের আড্ডা সুমনকে কখনওই ভাবতে দেয় না যে সে একা। খাবারের জোগাড় প্রায় শেষ। শীতে এই বৃষ্টির রাতে ডালে চালে খিচুড়ির থেকে আর সুখময় কিছু হতেই পারে না। সে খেতেই বসবে, তখনই দরজায় আওয়াজ হল, ……… ঠক্ ঠক্ ঠক্
এক অদ্ভূত নিস্তব্ধতা গোটা ঘর কে জেন মুড়ে ফেলেছে। সময় একদমই নষ্ট না করে সুমন বলে,
-কে ! কে এত রাতে?
কোনো সারা নেই। আবারও দরজায় টোকা পড়ল……. ঠক্ ঠক্ ঠক্।
সুমন খিচুড়ি বাড়তে বাড়তে উঠে দরজায় গেল। দরজা খুললে দেখে অনুভব এসে হাজির। এত রাতে তাকে দেখে সুমন বেশ অবাক হল। বেশ অদ্ভুত লাগছে তাকে। এত পরিপাটি হয়ে রাতের আড্ডায় সে এর আগে কখনও আসেনি।
-কি ভায়া এত রাতে যে ? কোথায় চললে এত রাতে ?
-এই তোমার সাথেই দেখা করতে এসেছি। তোমার সাথে দেখা করার পর বাসার লোকেদের সাথে শেষ দেখা করে পারি দেবে, বহুদূরে…….. বোধহয় কান্না কাটি শুরু করে দিয়েছে এতক্ষণে।
অনুভবের গলাটা বেশ অদ্ভুত শোনাল, কিছু বোঝবার আগেই লোডশেডিং এ ঘরের আলো নিভে যায়। মোবাইল ফোনে হওয়া গানটিও কখন যেন বন্ধ হয়ে গেছে।
-এলাম, ভালো থেকো।
অনুভবের পায়ের আওয়াজ শোনা যায় খালি। বাইরে উত্তরের শীতল বাতাস যেন সুমনের হার পাঁজর চেপে ধরে রেখেছে। সুমন চেল্লিয়ে জিজ্ঞেস করে,
-আরে ভায়া যাচ্ছেন টা কোথায়? আর কবে ফিরবেন ?
কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি অনুভবের থেকে। রাতের অন্ধকারে ক্রমশ মলিন হয়ে গেল তাঁর ছায়া।
হঠাৎ মোবাইলে এর আওয়াজে তার হৃৎপিন্ড বেরিয়ে আসার জের। মোবাইলের স্ক্রিনে ফুটে উঠলো অনুভবের বাসার নম্বর সাথে তার হাসি মুখের ছবি। রিসিভ করা মাত্র ওপার থেকে কান্নার আওয়াজ ভেসে আসলো সুমনের কানে, তারই মাঝে এক ভদ্রলোকের গলা । একটু অবাক হলাম। নিশ্চয়ই এটা সাহেব দার গলা । পাশের কান্না শুনে থেমে থাকতে পারিনি। জিজ্ঞাসা করলাম,
-কি হয়েছে সাহেব দা ? সব ঠিক আছে তো?
-না ভাই অনুভব আর নেই। বিকেলে রেলে কাটা পরেছে। তুমি এসো, ওকে সবে মাত্র আনা হয়েছে।
শোনা মাত্র এক হিমশীতল স্রোত তার মেরুদণ্ড দিয়ে নেমে গেল। নিস্তব্ধতা গ্রাস করল তাকে।
সত্যি অনুভব এসেছিল?
তার সাথে শেষ দেখা করতে?
লেখক পরিচিতি :
সানি বাগ,
কলকাতা, উত্তর ২৪ পরগনা এর অধিবাসী।
জন্ম ৩ রা জুন, ২০০১ বর্তমানে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের
অন্তর্গত শেঠ আনন্দরাম জয়পুরিয়া কলেজের
দ্বিতীয় বর্ষের সাংবাদিকতা বিভাগের ছাত্র।