শূণ্যতার পথে

Share This Post

এ-বছর মানুষের আকাশে অদ্ভুত নক্ষত্র পতনের খেলা। ক্রমশ আকাশ শূন্যতার পথে। কালো মেঘ ঘনিয়েছে সর্বত্র। চারিধারে আবেগের বাঁধ ভাঙা ব্যথার জোয়ার। আদৌ কি আর কিছু বাকি আছে দেখবার! এ বড়ই নির্মম দুর্দশা।

এই পাতাঝড়া মরশুমে পৃথিবীর বুক থেকে মহীরূহের পতন। কেউ হারালো পুলু। কেউ বা অপু। হারিয়ে গেল অপুর সংসার। শিথিল হলেন শিল্পের সাগর — সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। মন উদাসীন আর সময় বড়ই নিথর। এক বিস্তার শিল্পের সমুদ্রে জোয়ার ভাটা থেমে গেল। অবসর নিল একটা যুগ।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন স্বয়ং একজন শিল্পের সাগর। সাধারণ মানুষের পক্ষে ওঁর শিল্পের ব্যাপ্তি স্পর্শ করা অসম্ভব। ওঁর করে যাওয়া সৃষ্টি উপলব্ধি করবার জন্য একটা জীবন কি যথেষ্ট! মানুষটা শুধুমাত্র জাত অভিনেতা নয়, পাশাপাশি অসাধারণ আবৃত্তি, ভাষা এবং উচ্চারণের উপর অসীম দখল রাখেন—এমনই মানুষ ছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। প্রতিভার বহর তলে ওঁর আরও এক অতুলনীয় প্রতিভা বারবার সাধারণ চোখের আড়াল হয়েছে। ওঁর কবিতা! যে মানুষটা অন্যের কবিতা পড়তে পড়তে অশ্রুপাতে ভিজিয়ে ফেলত চোয়াল, তাঁর নিজস্ব কবিতার বিস্তার বিশাল দ্বীপ সমূহ। অথচ লক্ষ করেনি অনেকেই।

 সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বেঁচে থাকা কালীন চোদ্দোটি কবিতার বই প্রকাশ করেছেন। তাঁর প্রথম কবিতার বই ‘জলপ্রপাতের ধারে দাঁড়াব বলে’— প্রকাশিত হয় ১৯৭৫ সালে। কবিতার বই প্রকাশের যাত্রা এখান থেকে শুরু হলেও লিখে চলেছেন স্কুল জীবনের শেষে এবং কলেজ জীবনের গোড়া থেকেই। সেই সময়, ওঁর এক ডাইরির প্রথম পাতায় লেখা ছিল — ‘কে গো তুমি, দ্বীপান্বিতা?’ অবশ্যই কবিতার নাম ‘দ্বীপান্বিতা’। অনুপ্রেরণা আর কবিতার পথ হয়তো এখান থেকেই শুরু। ভবিষ্যতে কবিতা থেকে সংসার পর্যন্ত সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় একই ভাবে হেঁটে গেছেন দীপার সঙ্গে। জীবনে বিভিন্ন সময় হোঁচট খেলেও থামেননি কোত্থাও কখনও। জীবনযাত্রায় প্রতিটি ধাপে বিভিন্ন উপলব্ধি যুক্ত করেছেন তাঁর কবিতা মালায়। সময়ের হাত ধরে প্রকাশিত হয়েছে ওঁর বিভিন্ন কবিতার বই — ‘ব্যক্তিগত নক্ষত্রমালা’ , ‘শব্দেরা আমার বাগানে পড়ে আছে’, ‘চন্দনের চিতা’ , ‘হায় চিরজল’ , ‘পদ্মবীজের মালা’ , ‘হে সায়ংকাল’ , ‘জন্ম যায় জন্ম যাবে…’, আরো অনেক।

এখানেই শেষ নয়, সিগনেট প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়েছে সৌমিত্রর কবিতার সংকলন— ‘মধ্যরাতের সংকেত’। ৪৮টি কবিতার এই সংকলনে স্বতন্ত্র এক সৌমিত্র, শুরুতে লিখেছেন— ‘আমি কবিতার চলতে শুরু করার সাক্ষী/ আমি দেখতে পেয়েছিলাম/ চলতে চলতে সে এই শহর ছাড়িয়ে যাচ্ছে/ প্রথম মেঘ যেমন করে আকাশ ঢেকে ফেলতে থাকে/ প্রথম প্রেম যেমন…’। এখানে আমাদের পুলু বা অপু নয় স্বয়ং সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় খুঁজে পাচ্ছেন তার কবিতার শরীর। ২০১৯ -এ প্রকাশিত হয় ৮০০ পাতার এক বিশেষ কবিতার সংকলন। প্রকাশ পর্ব এখানেই কি শেষ…..!

সময়ে অসময়ে  তাঁর জীবনে ইন্ডাস্ট্রি গভীর ছাপ ফেলেছে। জীবনবোধ, ভিড় থেকে সরে একটু অন্য ধারার সিনেমা তাঁকে বিশেষ স্থান করে দিলেও তাঁর একাকীত্ব একটা বাড়ি তৈরি করতে সাহায্য করছে সময়সাপেক্ষ। এই একাকীত্ব তাঁর লেখার ইন্ধন হয়তো । যার পড়াশোনার ব্যাপ্তিও অসীম। নিজস্ব পড়াশোনা তিনি কখনোই থামাননি। জীবনের শেষ কটা দিন পর্যন্ত পড়েছেন জেমস স্যাপিরোর লেখা ‘১৬০৬— ‘উইলিয়াম শেক্সপিয়র অ্যান্ড দ্য ইয়ার অফ লিয়ার’ বইটি। তাঁর ভাবনার নিশ্বাসপ্রশ্বাস ক্লান্তিহীন। যে কোনো পরিস্থিতিতে বিলীন থাকতেন তাঁর ভাবনার জগতে,সাহিত্যের জগতে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনের লাইফলাইন। তাই তো বলেছিলেন জীবন শেষে তিনি গীতবিতান আর আবোলতাবোল নিয়ে থাকতে চান। হয়তো তাই পেরেছেন।

মুগ্ধ করার মতো যার মেধা। মনে রাখার অসীম ক্ষমতা। সাবলীল অভিনয়ের বাগান। লিখে যাওয়া তাঁর রক্তে। চর্চা তাঁর স্বভাবে। ৮৫ বছরের সঞ্চয়ের শিল্পমালা আমাদের জন্য রেখে গেছেন। শেখার অনন্ত সুযোগ রেখে গেছেন। কবিতার মুগ্ধতা রেখে গেছেন। চিত্রনাট্য রেখে গেছেন। এ-কী শুধুই বাংলার ক্ষতি গোটা বিশ্বের আকাশে নক্ষত্র পতন।

-বিশ্বরূপ হাওলাদার

Share This Post

Subscribe To Our Newsletter

Get updates and learn from the best

More To Explore

Do You Want To express your thoughts

drop us a line and keep in touch