-লাস্ট টেবিলে কী কী নিল রে?
-আটটা রুটি,ডিম তড়কা দু প্লেট।
-আর কজন আছে?
-আরেকটা পার্টি এলো এই।
-নাহিদ কোথায় ?
-বাইরে।
-ঠিক আছে, ঠিক করে হিসাব মিটিয়ে বন্ধ করিস।
-আচ্ছা ।
পাশের রাস্তা দিয়ে অনুকূলের চলে যাওয়ার দিকে চেয়ে রইলো গনেশ। গনেশ মাঝি, তের বছর বয়েস। ক্লাস সেভেনেএ পড়ার বয়স হলেও ফাইভ পাশ। বাড়ি বীরভুমের লাভপুরে। যদিও বাড়ি নয়, গ্রামের নয়ন হালদারের বাড়িতে ভাড়া থাকতো। মা মারা গেছে গনেশ হওয়ার পরেই, বাবা দীনেশ বলতো গনেশকে নাকি মা মিনতির মতই দেখতে। তা বাপটাও খুন হলো পার্টির ঝামেলায়। তখন গনেশ দশ, শিবু চৌদ্দ । নয়ন হালদারই তখন গনেশকে কাজে লাগায় এই অনুকুলের ধাবায় আর দাদা শিবুকে কলকাতায় একটা কারখানায় লাগিয়ে দেয় । অনুকুলের ধাবাটা হাইরোডের ধারে,। তারাপীঠের যাত্রী-লড়ি ড্রাইভার, সব মিলিয়ে ভিড় লেগেই আছে। গনেশ বাসন ধোয়ার কাজ করে। রাতে দোকানেই সে ঘুমায়, আগে নাহিদ ঘুমাতো সাথে, এখন ওর চাচার বাড়ি চলে যায়। একাই শুতে হয় গনেশকে। এখানে কাজ করতে তার ভালো লাগেনা তার। একে দোকানের হারভাঙ্গা খাটনি, তার ওপর অনুকূল কাকার মুখঝামটা । সর্বক্ষণ তো লেগেই আছে, তার সাথে ভুলচুক হলে গায়ে হাত তোলে কখনো। নাহিদদাও আড়ালে গাল পাড়ে অনুকূলকাকাকে, বলে দুনম্বরী বিজনেস আছে। এদিকে দাদা শিবুটাও হয়েছে তেমনি। খুব একটা আসেও না এদিকে। কতবার বলেছে গনেশ, ওকে কলকাতায় নিয়ে যেতে, একসাথে কাজ করবে। খালি বলে ‘বড় হ নিয়ে যাবো ’। দোকান বন্ধ করে কাজ মিটিয়ে এইসব ভাবতে ভাবতেই চোখ বুজে আসে গনেশের।
টালির চালে খুট করে আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে গেল গনেশের। আজকাল কি হয়েছে কে জানে, তার বড্ড ভয় লাগে। সব দোষ নাহিদদার,নাহিদদা বলেছে রাতে নাকি জিন পরীরা নেমে আসে, তাদের অনেকেই নাকি বাচ্চাদের ধরে নিয়ে যায়। হাত পা সিঁটিয়ে যায় পেটের ভেতর। খালি মনে হয় কারা যেন ঘুরে বেড়াচ্ছে ধাবার চারপাশে । দেয়াল বেয়ে উঠছে, টালির চালে হাঁটছে, আবার নেমে আসছে, পেছনে অশত্থগাছটার ডাল বেয়ে। কুঁকড়ে যায় সে । একবার গনেশ সাহস করে মাঝরাতে বেড়িয়েছিল দোকানের চাবি খুলে, সেদিন পূর্নিমা ছিল । গ্রামের মাসুদ চাচার দোকানের সবচেয়ে বড় চাঁদিয়াল ঘুড়িটার মত ইয়া একখানা চাঁদ উঠেছিল। সামনের হাইওয়ের রাস্তাটা, ওপারের দীঘিটা ধোয়া অ্যালুমিনিয়াম প্লেটের মত চকচক করছিল। নাহিদদাকে বলায় বলেছিল এরকম ভরা চাঁদের রাতেই নাকি জিন-পরীরা নেমে আসে, ভাগ্যিস তার কিছু হয়নি।
খটাস করে দরজায় আরেকটা শব্দে এবার রীতিমত ভয় পেল গনেশ, ঠিক শুনলো না মনের ভুল ঠাওর করতে পারলো না। সন্ধ্যেবেলায় অনুকূলকাকা বলছিল আজ নাকি কী একটা পূর্নিমা । হয়তো ওরা নেমে এসেছে, নিঃশ্বাসের শব্দ পড়ছে দরজায় । আর থাকতে পারলো না গনেশ, অন্ধকারে হাতড়ে গিয়ে লাইটটা জ্বালালো। সেপ্টেম্বর মাস, ছোট ফ্যানটা চলছে, তাও ঘামছে গনেশ। বাইরে বেড়োনোর প্রশ্নই নেই। বরং ভয় লাগছে ওরা ভেতরে না চলে আসে । এখানে থাকলে সে ভয়েই মরে যাবে, এদিকে রাতে আলো অকারণে জ্বলেছে শুনলে অনুকূলকাকা হাতপাখাটা দিয়েই মারতে শুরু করবে! গলার কাছে একদলা কান্না উঠে আসে তার। হঠাৎ গনেশের মনে পড়লো, নাহিদদা বলেছিল অনেক জিন নাকি ভালো হয়,পূর্নিমার রাতে মানুষ যা চায় দেয়। আচ্ছা আজ তো পূর্নিমা , আজ দাদাকে চিঠি লিখলে কেমন হয়! যদি জিন পরীরা শোনে! দাদা নিয়ে যায় কলকাতায় ! ফোন করার উপায় নেই, দাদার ফোন থাকলেও ওর নেই, আর দাদার নম্বরও জানেনা। বরং চিঠি লেখা ভালো, ফাইভে সে শিখেছিল স্কুলে । হিেবের টেবিলে একটা পুরোনো খাতা ছিল, পেছনের পাতাটা খুব সাবধানে ছিঁড়লো,অনুকূলকাকা জানলে ছাল তুলে দেবে!ড্রয়ারে একটা পেন ছিল, সেটা নিয়ে চৌকির ওপর গিয়ে লিখতে শুরু করলো। ওপরে বাঁদিকে যাকে পাঠাতে হবে নাম লিখতে হয় দেখেছে। প্রথমে লিখলো ‘দাদা’। ধুর দাদা কারোর নাম হয় নাকি! কেটে লিখলো ‘শিবনাথ মাঝি’ , দাদার ভালোনাম। আবার লিখতে শুরু করলো সে,“দাদা, তুই কেমন আছিস? জানুয়ারির পরে আর তো এলিইই না। আমি ভালো নেই”। থেমে কিছুক্ষণ ভাবলো কী লিখবে। আবার শুরু করলো “অনুকূল কাকা হারামী লোক। নাহিদদা বলে, বলে নাকি কিসব ফোর টুয়েন্টি বিজনেস আছে”। লিখে কেটে দেবে ভাবলো গনেশ, তারপর ভাবলো “না থাক”। আবার শুরু করলো সে “খুউব মুখখারাপ জানিস, গায়ে হাত তোলে । ওদিন একজন ধাবায় মাল খেয়ে দুটো গ্লাস ভাঙ্গলো, আমায় থালা দিয়ে মারলো, নাহিদদাকেও বাজে কথা বলে। ওও বলছে ছেড়ে দেবে”। এবার ভাবলো জিনেদের কথা লিখবে। “আমাদের এখানে জিন আছে জানিস, রাতে একা ঘুমাতে ভয় লাগে, আমি ভালো নেই রে দাদা। আমাকে নিয়ে যাবি কলকাতা? আমি পারছি না রে এখানে থাকতে। নাহিদ দা বলেছে , কলকাতায় জিন নেই । বেশী ভিড়ে থাকে না ওরা ” । লেখা থামালো গনেশ । শেষে লিখলো নিজের নাম ‘গনেশ মাঝি’। আবার মনে পড়লো দাদার ঠিকানাটা লিখতে হবে, কিন্তু পুরো ঠিকানা জানা নেই। তাও যেটুকু মনে আছে লিখলো সে, “১২/৩ মুক্তারাম বাবু রোড, কলকাতা”। কাল নাহিদদা কে বলতে হবে চিঠি টা ফেলে আসতে , পোস্ট অফিস কাছেই । নাহ সে নিজেই যাবে । অনুকূলকাকা জানতে পারলে সর্বনাশ । সব গুছিয়ে চিঠিটা পকেটে রেখে ঘুমোতে গেল সে। রাত শেষের দিকে।
যখন গনেশ ঘুমাতে গেল তখন উত্তর কলকাতার একটা পাড়াও ঘুমাচ্ছে অঘোরে। শহরটা এই সময়ে সবচেয়ে বেশী তন্দ্রাচ্ছন্ন থাকে। কেবল একটা বাড়িতে আলো জ্বলছে। ডাইনিং রুমে একমুখ আতঙ্ক নিয়ে বসে আছে শিবু। সামনে মাঝবয়সী ভদ্রমহিলা । শিবু চুপ করে থাকায় তিনিই মুখ খুললেন।
-পুলিশের বাড়ি চুড়ি করতে ঢুকেছিল !
-জানতাম না।
-বাড়ি কোথায়?
-লাভপুর, নওপাড়া গ্রাম।
-এখানে কোথায় থাকো ?
-মুক্তারাম বাবু স্ট্রিট।
-কি করো ?
– তারের কারখানায় কাজ।
-চুরি করো কেন তাহলে ?
– মাইনে দেয়না ঠিকমতো , বোনাসও দেয়নি । ভাই জামা চেয়েছিলো ।
-পড়াশুনো কতদূর ?
-সিক্স ক্লাস অবধি পড়েছি।
-তারপর?
-বাবা মারা গেল।
-ও! আর কে আছে বাড়িতে?
-ভাই। ওখানেই ধাবায় কাজ করে।
-আমার এখানে থাকবে ?
-কেন ?
-কেন মানে ! চুরি করতে ভালো লাগে ? কাজ করাবো না । একটা স্কুল চালাই , সেখানে পড়বে আর হেল্প করবে আমায় ।
-না , কিন্ত অচেনা ….
-তোমার কারখানার মালিক তো চেনা , মাইনে দিত ? কারখানায় কাজ করতে হবে না, চুরি করতে হবে না।
-ভাই আছে।
-বাবাহ। ভাইয়ের ব্যবস্থাও করছো। ঠিক আছে নিয়ে আসবে তাকে , সেও থাকবে।
মাথা নাড়লো শিবু।
-শরবৎ খাবে ?
মাথা নাড়লো শিবু। মহিলা ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলেন।
ঘরের মধ্যে চুপ করে বসেছিল শিবু। বুঝতে পারছেনা ঠিক করলো না ভুল। তবে মনে হচ্ছে চামার রাজীবদার তারের কারখানায় কাজ করার চেয়ে ভালো। আর ভাইটারও ব্যবস্থা হবে। তার অনেকক্ষণ ধরে মনে হচ্ছিল মহিলাকে কোথায় যেন দেখেছে সে। দেওয়ালে রাখা একটা ছবিতে চোখ আটকালো তার। মহিলার একটু কম বয়সের ছবি। সমুদ্রের ধারে,সাথে দুটো বাচ্চা । দুজনেই খুব হাসছে। আর তার পাশেই বাচ্চাদুটোর একটা করে একটু বড়বেলার ছবি আর তাতে মালা পরানো । বুকটা ধক করে উঠলো শিবুর। এবার তাঁর মনে পড়লো ভদ্রমহিলাকে অনেকটা তাদের মায়ের মতো দেখতে!!
(অ্যান্টন চেকভের Vanka গল্প থেকে অনুপ্রানিত )
লেখক পরিচিতি : সোমনাথ ঘোষ
(পেশায় শিক্ষক )