একুশের যুগে যখন গোটা দুনিয়ার আদর্শ, সংস্কৃতি দেউলিয়া হতে বসেছে, যৌবনে যখন সেপারেশন এবং ডিপ্রেশনের হতাশায় ভুগছেন, তখন গায়েত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের নামটাই আলোচ্য হয়ে উঠেছে।
বিশ্বজয়ী ৭৯ বছর বয়সী এই মহীয়সী বরাবরই ‘নারীবাদী-মাক্সবাদী-বিনির্মাণবাদী’ বলে নিজেকে প্রকাশ করতে পছন্দ করেন। স্পিভাকের জন্ম হয় কলকাতায়, ভারত স্বাধীন হওয়ার পাঁচ বছর আগে, ১৯৪২ সালে৷ পিতা পরেশচন্দ্র চক্রবর্তী, মা শিবানী চক্রবর্তী৷ বাংলার মহামন্বন্তর তাঁর প্রথম স্মৃতি৷ গায়ত্রী তখন সেন্ট জনস ডায়োসেশন স্কুল-এর ছাত্রী৷ বাড়ি ছিল মুসলমান মহল্লার সীমান্তে৷ তাঁর পিতা বহু মুসলমান মানুষকে আশ্রয় দিয়েছিলেন তাঁদের বাড়িতে৷ এই সব ব্যক্তিগত স্মৃতি ও আখ্যান গায়ত্রীর কাছে তাত্পর্যপূর্ণ, কারণ তার মধ্যে থেকেই তিনি খুঁজে পান তাঁর তত্ত্বনির্মাণের রসদ৷
বিদ্যালয়ের পঠনপাঠন শেষ হলে গায়ত্রী ভর্তি হন প্রেসিডেন্সি কলেজে ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী হিসেবে৷ শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন তারকনাথ সেনের মতো কিংবদন্তি মানুষকে৷ প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে স্নাতক উপাধি অর্জন করেন৷ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর পর্যায়ের পড়াশুনোর মধ্যেই পাড়ি দেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে৷ যদিও সেই সময়ের ভারতীয় পড়ুয়াদের স্বাভাবিক গন্তব্য ছিল ইংল্যান্ড, কিন্তু গায়ত্রী ভাবনায় ভিন্ন পথের পথিক৷ তাঁর মনে হয়েছিল ইংল্যান্ড-এর বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থার ফারাক যৎসামান্য৷ অতঃপর কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর পড়াশুনার পাঠ সাঙ্গ করে সেই বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই ১৯৬৭ সালে তুলনামূলক সাহিত্যে ডক্টরেট উপাধি পান৷ গবেষণার বিষয় ডব্লু বি ইয়েটস-এর জীবন ও কবিতা৷
‘পাশ্চাত্য’ কনসেপ্টজনিত হায়ারার্কিকে নানাভাবে প্রশ্ন করতে শেখান স্পিভাক। আর এই পশ্চিমী অধ্যায় নিয়ে প্রশ্ন করতে করতে তৈরি হয় ইতিহাস। গায়ত্রী লেখেন ‘ক্যান দ্য সাব অল্টার্ন স্পিক?’৷ পশ্চিমি বিদ্যাচর্চার জগত্ নিম্নবর্গকে যে ভাবে চিত্রায়িত করে এসেছে, তারই একটি চিন্তাঋদ্ধ সমালোচনা৷ যার থেকে উঠে আসা মৌলিক প্রশ্নটি এখন প্রবাদপ্রতিম, ‘নিম্নবর্গের কি কোনও ভাষা আছে?’৷
স্পিভাক ‘ক্যান দ্য সাবঅল্টার্ন স্পিক’ -এ এক সুন্দর বিবরণ দিয়েছিলেন। তাঁর কথার, “Where possible, this model resistance is not an alternative to, but can compliment, macrological struggles along ‘Marxist’ lines. Yet if its situation is universalized, it accomodates unacknowledged privileging of the subject. Without a theory of ideology, it can lead to a dangerous utopianism.”
এখানেই অবশ্য থেমে থাকেননি স্পিভাক। কারণ তিনি থামতে শেখেননি। এরপর তিনি অনুবাদ করেন মহাশ্বেতা দেবীকে। এই অনুবাদটার মাধ্যমে পিছিয়ে পরা ভারতীয় জনগোষ্ঠীর কথা দুনিয়ার সামনে নিয়ে আসলেন তিনি। স্পিভাকের এই স্বাধীনচেতা ধারণা বুদ্ধিজীবী মহলকে অস্বস্তিতে ফেলেছিল। সেই সময়ের তথাকথিত উচ্চ-মধ্যমিত্তের নিম্নমানের ব্যক্তিদের উপর হওয়া শোষণের কথা তিনি দুনিয়ার সামনে নিয়ে আসতে শুরু করলেন। অধ্যাপনা ও গবেষণার পাশাপাশি গায়ত্রী অবিরত ব্যস্ত অনুবাদে৷
স্পিভাকের মতে, আজকের ভারতে এই কথাটা আগের চেয়েও বেশি গুরুত্ব দিয়ে ভাবা দরকার। বোঝা দরকার, গ্রামেগঞ্জে স্কুলকলেজ তৈরি হলে কী হবে, তাদের ভাবনা আর এলিটের ভাবনা ধারার মধ্যে আজও তেমন সংযোগ নেই। অথচ বিশ্বের সেরা বিদ্যাচর্চার সঙ্গে যুক্ত থাকতে থাকতেও গায়ত্রী নিজে প্রত্যন্ত গ্রামের ছেলেমেয়েদের বসিয়ে পড়ান, নিউ ইয়র্ক থেকে প্রতি বছর বাংলা-ঝাড়খণ্ড সীমানার নাম-না-জানা গ্রামে নিয়মিত যাতায়াত করেন। তাঁর মুখ থেকে দেশীয় উচ্চশিক্ষা-সমাজের এই ভর্ৎসনা স্বাভাবিক ভাবেই প্রাপ্য।
তাঁর অনবদ্য উদাহরণে, “তা ‘স্লো কুকিং’ বা ঢিমে আঁচে রান্নার মতো। কার আছে সেই সময়? বিশেষ করে চতুর্দিকে সবাই যখন ‘ফান্ড রেজিং’-এর তাড়নায় নাজেহাল। অথচ এই মানুষগুলোই আমাদের দেশের নাগরিক, ভোটের ভোটার, গণতন্ত্রের ‘গণ’। গ্লোবাল হায়ার এডুকেশন বা বিশ্বমানের উচ্চশিক্ষা নিয়ে ভাবতে বসে এদের কথাই ভাবতে হবে বই কী। আর একমাত্র মানবী বিদ্যার পথেই সেটা সম্ভব”, বলে গেলেন স্পিভাক।
লেখক পরিচিতি
প্রিয়াঙ্কা দত্ত
(ইন্টার্ন)
জন্ম- ১৯৯৮
বসিরহাট সংলগ্ন অঞ্চল বাদুড়িয়াতে বেড়ে ওঠা।
বর্তমানে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা বিষয়ে দ্বিতীয় বর্ষে পঠনরত।