সালটা ১৮৮৫, শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ ক্লার্জিম্যান’স থ্রোট রোগে আক্রান্ত হন। ক্রমে এই রোগ গলার ক্যানসারের আকার ধারণ করে। তখন তিনি দক্ষিণেশ্বরে। তৎকালীন বড় বড় ডাক্তাররা তাঁকে পরীক্ষা করে দেখলেন। তাঁরা বললেন, বায়ু পরিবর্তন দরকার।
কলকাতার শ্যামপুকুর অঞ্চলে তাঁকে নিয়ে আসা হয়। বিশিষ্ট চিকিৎসক মহেন্দ্রলাল সরকার তাঁর চিকিৎসায় নিযুক্ত হন। কিন্তু সেই জায়গা ঠাকুরের পছন্দ হল না। কারণ, স্থানের অভাব। অবস্থা সংকটজনক হলে ১৮৮৫ সালের ১১ ডিসেম্বর তারিখে তাঁকে স্থানান্তরিত করা হয় কাশীপুরের এক বিরাট বাগানবাড়িতে। তাঁর চিকিৎসা চলতে লাগল। তাঁর সন্ন্যাসীসন্তানরা দিনরাত ঠাকুরের সেবা করতে লাগলেন। ও তাঁর দুর্লভ সান্নিধ্য লাভে ধন্য হতে থাকলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ থাকতেন কাশীপুর উদ্যানবাটীর দোতলার একটি ঘরে। ১৮৮৬ সালের ১লা জানুয়ারি সকালবেলায় হঠাৎ তিনি সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলেন নীচের বাগানে। ঘুরতে লাগলেন বাগানের চারিপাশে। সে দিন শরীরটা তাঁর একটু ভাল লাগছিল। নীচের বাগানে তখন প্রায় ৩০ জন গৃহীভক্ত ছিলেন যাঁর মধ্যে ছিলেন বিখ্যাত নট, নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ঘোষও। তিনি চারদিকে ঠাকুরের অবতারত্ব, তাঁর বিরাটত্ব, তাঁর অনন্যতা সম্পর্কে বলে বেড়াতেন। শ্রীরামকৃষ্ণ বাগানবাড়িতে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ গিরিশের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘‘হ্যাঁ গো, তুমি যে আমার সম্পর্কে এত কিছু বলে বেড়াও, আমাকে তুমি কী বুঝেছো?’’
গিরিশ ঘোষ ঠাকুরের সামনে তখন নতজানু হয়ে বসে পড়ে বললেন, ‘‘ব্যাস-বাল্মিকী যাঁর ইয়ত্তা করতে পারেনি, এই অধম গিরিশ তাঁর কি বলবে।’’ অদ্ভুত গদগদ কণ্ঠে অসামান্য ভাবে পরিপূর্ণ হয়ে গিরিশচন্দ্র এই অপূর্ব কথাগুলি যেই বললেন, অমনি শ্রীরামকৃষ্ণের ভাবসমাধি হল। তিনি বললেন, ‘‘তোমাদের আর কী বলব? তোমাদের চৈতন্য হোক।’’
সেখানে আর যাঁরা ভক্ত ছিলেন তাঁরা হঠাৎ দৌড়ে এসে চিৎকার করে বলতে লাগলেন, ‘‘ওরে তোরা কে কোথায় আছিস, দৌড়ে আয়। ঠাকুর আজ কল্পতরু হয়েছেন।’’ ঠাকুরকে ঘিরে সকলে হাতজোড় করে তাঁর কাছে প্রার্থনা করছেন আর সকলের অন্তরে অদ্ভুত পরিবর্তন আসছে। ভিতরের সমস্ত ভাবরাশি বাইরে বেরিয়ে আসছে অনর্গল ধারায়। ঠাকুর সকলকে স্পর্শ করছেন আর বলছেন, ‘‘তোমাদের চৈতন্য হোক।’’ এই সময়ে ঠাকুর উপস্থিত গৃহ-ভক্তদের বুক পিঠে হাত বুলিয়ে দেন। সেই স্পর্শে অলৌকিকের ছোঁয়া অনুভব করেছিলেন উপস্থিত গৃহী ভক্ত ও অন্যান্য ঠাকুর-ঘনিষ্ঠরা।
শ্রীরামকৃষ্ণ সে দিন কল্পতরু হয়েছিলেন আর সকলকে অভয়দান করে বলেছিলেন, ‘‘তোমাদের চৈতন্য হোক।’’ অর্থ নয়, নাম নয়, যশ নয়, প্রতিপত্তি নয়, ঠাকুর সে দিন চৈতন্য বিতরণ করেছিলেন। ঠাকুর সে দিন কল্পতরু হয়েছিলেন আমাদের অন্তরস্থিত চেতনার উন্মীলনের জন্য। ঠাকুরের এই উক্তিকে পরম মহিমা বলে মনে করেন ভক্তরা। স্বীয় হৃদয়ে মানুষের দুঃখ যন্ত্রণা অনুভব করেই যেন ঠাকুরের এই আশীর্বাদ— চিন্ময় চৈতন্য সত্তার জাগরণের আশিস।
কল্পতরু সম্পর্কে পুরাণে বলা আছে, এ এক আশ্চর্য গাছ যার কাছে নাকি যা চাওয়া যায় তাই পাওয়া যায়। সেই গাছ নিয়েই একটি গল্প আছে। পথশ্রমে ক্লান্ত এক ব্যক্তি একটি গাছের নীচে গিয়ে দাঁড়ালেন। গাছটি যে কল্পতরু তা তিনি জানতেন না। হঠাৎ তিনি ভাবলেন, ‘‘খুব তেষ্টা পেয়েছে, একটু যদি জল পেতাম তো খুব ভাল হত।’’ ও বাবা, ভাবনা শেষ হতে না হতেই নানা রকম জল এসে হাজির। এ বার তার মনে হল, ‘‘একটু খাবার পেলে বেশ ভাল হত।’’ অমনি সুস্বাদু সব খাবার উপস্থিত। বিশ্রামের কথা ভাবতেই অমনি প্রস্তুত সুরম্য বিশ্রামাগার। এ বার তিনি ভাবলেন, ‘‘যদি কেউ একটু পা টিপে দিত, ঘুমটি বেশ ভাল হত।’’ এক সুন্দরী মহিলা অমনি উপস্থিত। হঠাৎ তাঁর মনে হল, ‘‘এত সুখ আমার কপালে সইবে তো? হঠাৎ যদি বাঘ এসে হাজির হয়!’’ ভাবা মাত্র বাঘ এসে হাজির হয়ে লোকটিকে খেয়ে ফেলল।
এই রূপক গল্পটির অন্তরালে যে রূপটি রয়েছে তা হল, চাইতে জানতে হয়। কল্পতরু কল্পনারই গাছ। কিন্তু সে যদি বাস্তব হত তবে কী চাইতাম তার কাছে? আমাদের মনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা আকাঙ্ক্ষা তো পরিপূর্ণ তৃপ্তি দেয় না কোনও দিনই। চাইতে হবে সেই সত্যের খোঁজ যা চিরকালীন, যা অনন্তস্পর্শী।
আজ থেকে এত বছর আগে শ্রীরামকৃষ্ণ এই দিনে আমাদের চৈতন্যের উন্মেষের কথা বলেছিলেন। আজ সমকালের দিকে তাকিয়ে মনে হয়, আজ এই চৈতন্যেরই একান্ত প্রয়োজন যার অভাবে সমস্ত সম্পদ থাকা সত্ত্বেও আমরা ছুটে চলেছি এক অসীম অভাবের দিকে, আসন্ন ধ্বংসের দিকে। আজ কল্পতরু দিবসে শ্রীরামকৃষ্ণের সেই কথাটিই চারিদিকে ধ্বনিত, প্রতিধ্বনিত হোক, ‘‘তোমাদের চৈতন্য হোক।’’
শান্তনু দত্ত
বিদ্যাসাগর কলেজ