ফ্রেঞ্চ নিউ ওয়েভের সাথে সিনেমার ইতিহাসে আধুনিকতার সূত্রপাত হয় – এই কথাটা বললে অত্যুক্তি করা হবেনা । ফ্রেঞ্চ নিউ ওয়েভ সিনেমার ইতিহাসে একটা ‘মুভমেন্ট’ যা পঞ্চাশের দশকের শেষভাগে কিছু তরুণ ফরাসী চিত্রপরিচালকের হাত ধরে শুরু হয় ।
ফ্রেঞ্চ নিউ ওয়েভের কথা বলতে গেলে দুজন এমন মানুষের কথা বলতে হয় যারা ছবি-করিয়ে ছিলেন না — এদের মধ্যে আন্দ্রে বাজা ছিলেন ফিল্ম ক্রিটিক অর্থাৎ ছবি নিয়ে লেখালেখি ছিল তাঁর পেশা , আর অরি লাংলোয়া ছিলেন ফিল্ম আর্কাইভিস্ট অর্থাৎ বিভিন্ন ছবির প্রিণ্ট জোগাড় করে সেগুলি সংরক্ষণ করা ছিল তাঁর পেশা । অরি লাংলোয়া ছিলেন সিনেমাথেক ফ্রসে ‘র একজন প্রতিষ্ঠাতা । এই সিনেমাথেক ফ্রসে’তে নিয়মিত যাওয়া আসা ছিল একদল তরুণের । এদের মধ্যে জা লুক গোদার , ফ্রাসোয়া ত্রূফো , এরিক রোমের , জাক রিভেত, ক্লদ শ্যাব্রল পরবর্তীকালে ফ্রেঞ্চ নিউ ওয়েভের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পরিচালক হয়ে ওঠেন । সিনেমাথেক ফ্রসেতে দেশবিদেশ থেকে হরেক রকমের ছবি দেখে সিনেমার ইতিহাস এবং বিভিন্ন দেশের ছবি সম্পর্কে এই তরুণ দর্শকদের মনে সম্যক ধারণা গড়ে ওঠে । এখানেই তাদের পরিচয় ঘটে বিভিন্ন দেশের নির্বাক ছবির সাথে , পরিচয় হয় ক্লাসিকাল হলিউডের সাথে , ফরাসী সিনেমার সাথে ।
দ্বিতীয় যে মানুষটার কথা বলতে চাই তিনি হলেন আন্দ্রে বাজা । আন্দ্রে বাজার হাত ধরে ১৯৫১ সাল থেকে শুরু হয় সিনেমার ম্যাগাজিন কাহিয়ের দ্যু সিনেমা’র যাত্রা । এই ম্যাগাজিনের নিয়মিত লেখকদের মধ্যে ছিলেন এরিক রোমের , ফ্রাসোয়া ত্রূফো , জা লুক গোদার, জাক রিভেত , ক্লদ শ্যাব্রল প্রমুখ । সিনেমার ইতিহাস , বিভিন্ন ধরণের ছবি ও চিত্রপরিচালকদের স্টাইল , সিনেমা কেমন হওয়া উচিত — এসব নিয়ে তর্কবিতর্ক , মত আদান প্রদানের অন্যতম জায়গা হয়ে ওঠে কাহিয়ের দ্যু সিনেমা ।
ফ্রেঞ্চ নিউওয়েভের পরিচালকরা প্রথম সিনেমাকে অন্যান্য শিল্প মাধ্যম যেমন চিত্রকলা বা সাহিত্যের মতই গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম বলেন এবং চিত্রপরিচালকদের শিল্পী বা লেখকের মতই গুরুত্বপূর্ণ বলে দাবী করেন । ফরাসী ফিল্ম ক্রিটিক আলেক্সান্দ্রে আস্ত্রুক এই সময় ‘la camera stylo’ বা ক্যামেরাকে পেনের মত ব্যবহার করার পক্ষে কথা বলেন । এর অর্থ ছিল যে চিত্রপরিচালক তার ক্যামেরাকে নিজের ভাব প্রকাশের জন্য পেনের মতই ব্যক্তিগত ভাবপ্রকাশের মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করতে পারেন । এইভাবেই ফ্রেঞ্চ নিউ ওয়েভের মাধ্যমে প্রথম ‘ auteur theory’ -র উদ্ভব । চিত্রপরিচালকেরা হয়ে উঠলেন যে কোন ছবির প্রাণ এবং ছবির অন্যতম সৃষ্টিকর্তা । হলিউডের বিভিন্ন ধরণের ছবি দেখার পর ফ্রেঞ্চ নিউ ওয়েভের তরুণ তুর্কীরা হাওয়ারড হকস , জন ফোরড , আলফ্রেড হিচকক প্রমুখ পরিচালকদের কথা বলতে শুরু করেন । এদের মতে হিচকক বা জন ফোরড বা হাওয়ারড হকসের একটা ছবিতে পরিচালকের ছাপ ছিল স্পষ্ট , এগুলো দেখে কোনভাবেই মনে হত না প্রযোজক প্যারামাউন্ট বা ওয়ারনার ব্রাদার্সের আরও একটা ছবি ।
১৯৫৪ সালে ফ্রাসোয়া ত্রূফো কাহিয়ের দ্যু সিনেমা পত্রিকায় ‘ a certain tendency in French cinema’ নামে একটা প্রবন্ধ লেখেন । এই প্রবন্ধে জা রেনোয়া , ব্রেসো , জা ককতো বাদে অন্যান্য ফরাসী পরিচালকদের সিনেমাকে প্রবলভাবে আক্রমণ করেন ত্রূফো । ফরাসী সিনেমার ধরাবাঁধা ধরণকে আক্রমণ করে ত্রূফো লেখেন যে এই সিনেমার সাথে বাস্তব ফরাসী জীবনের রাজনীতি ও সমাজের কোন সংযোগ নেই । ইউরোপিয়ান সিনেমা ও ক্লাসিকাল হলিউডের রীতিনীতি ও ব্যাকরণের প্রতি একটা তীব্র অনীহা দেখা যায় এই নতুন পরিচালকদের মধ্যে । কন্টিনিউটি এডিটিং-এর বদলে জাম্প কাট , স্থির ক্যামেরার বদলে সর্বক্ষণ গতিময় একটা ক্যামেরা , ডকুমেন্টারি এবং ফিকশন ছবির ইডিয়মকে মিলিয়ে মিশিয়ে দেওয়া , দর্শককে সিনেমার উপস্থিতি সম্পর্কে সচেতন করে দেওয়া , সিনেমার প্রচলিত গল্প বলার ধরণকে অগ্রাহ্য করে নতুন ধরণের গল্প বলার ধরণকে নিয়ে কাজ করা , পরিচালকের দৃষ্টিভঙ্গি এবং দর্শনকে সিনেমায় প্রকাশ করা – ফর্ম এবং কন্টেন্টের দিক দিয়ে অভিনব এই রকম বেশ কিছু টেকনিক হয়ে ওঠে ফ্রেঞ্চ নিউ ওয়েভের অন্যতম বৈশিষ্ট্য । জা লুক গোদারের ‘a bout de soufflé ’ বা ‘breathless’ ছবিতে , ফ্রাসোয়া ত্রূফোর ‘ 400 blows’ বা জাক রিভেতের ‘paris nous appartient (paris belongs to us )’ ছবিতে ফ্রেঞ্চ নিউ ওয়েভের এই বৈশিষ্ট্যগুলি বেশ আলাদাভাবে বোঝা যায় । রাস্তাঘাটে সাধারণ মানুষের মাঝে নেমে আসে সচল একটা ক্যামেরা , সারা ছবি জুড়ে এক গতিময় ছন্দ এই ছবিগুলোর সারাটা জুড়ে ।
ফ্রেঞ্চ নিউ ওয়েভের পরিচালকদের মধ্যে মূলত দুটি ভাগ ছিল । এক দল ছিলেন কাহিয়ের দ্যু সিনেমা ‘র লেখকরা অর্থাৎ ফ্রাসোয়া ত্রূফো, জা লুক গোদার , ক্লদ শ্যাব্রল , জাক রিভেত , এরিক রোমের যারা প্রথমে প্ত্রিকায় লেখালেখি এবং পরে সিনেমা বানানো শুরু করেন । আর একদল চিত্রপরিচালক ছিলেন আগ্নেস ভারদা , আলা রেনে বা ক্রিস মার্কারের মত পরিচালকেরা – এদের বলা হত ‘লেফট ব্যাংক’ । আগ্নেস ভারদা ‘র ‘cleo from 5 to 7’ , ক্রিস মার্কারের স্টিল ফটোগ্রাফ দিয়ে তৈরি ছবি ‘ la jetee’ বা আলা রেনে ‘র ‘Hiroshima mon amour’ তুলে ধরে ফ্রেঞ্চ নিউ ওয়েভের কাব্যিক একটা দিক ।
ফ্রেঞ্চ নিউ ওয়েভ সিনেমার ইতিহাসকে সিনেমাকে চিরকালের জন্য বদলে দেয় । একদল তরুণ তুর্কী পরিচালকদের হাত ধরে সিনেমায় আসে নতুন প্রাণের স্পন্দন । পরবর্তীকালের সিনেমার ভাষাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল ফ্রেঞ্চ নিউ ওয়েভের পরিচালকেরা ।