সত্যজিৎ এর শিল্পীসত্ত্বা নিয়ে আলোচনার কোনো শেষ নেই।গ্রন্থচিত্রণে তাঁর অবদান অভূতপূর্ব ও বৈপ্লবিক।সেই একই সঙ্গে তাঁর অন্য শিল্পচর্চার ক্ষেত্রও সমান গুরুত্বপূর্ণ।প্রতিকৃতি শিল্পী হিসাবে তাঁর করা অসংখ্য প্রতিকৃতি, অধিকাংশই ম্যাগাজিন কিংবা বই-এ ছাপার জন্য অবশ্যই খুব গুরুত্বপূর্ণ সংগ্রহ। চ্যাপলিন,ব্র্যান্ডো,রবীন্দ্রনাথ,সুকুমার,নন্দলালের মতো অনেকের প্রচুর প্রতিকৃতি এঁকেছেন। অক্ষরশিল্প বা ক্যালিগ্রাফিকে সত্যজিৎ ব্যবহার করেছিলেন নিজের মতো করে।বইয়ের প্রচ্ছদে ব্যবহৃত সেই সব লেখাঙ্কন অনুপ্রাণিত করে এখনকার প্রজন্মের প্রচ্ছদ শিল্পীদের।এমনকি ক্যালিগ্রাফির জাদু দেখা যায় তাঁর সিনেমার পোস্টারেও। সেটা ‘গুপী গাইন’ হোক অথবা ‘দেবী’। সব ক্ষেত্রেই নিজ নিজ পরিচয় রেখেছেন তিনি। ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’র পোস্টারে সাদা কালো শালবনের দৃশ্য সত্যিই আশ্চর্য। কল্পনাশক্তি ছিল তাঁর সব থেকে বড়ো ক্ষমতা। আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্য ছাড়াই তিনি এসব করে দেখিয়েছিলেন। সত্যজিৎ পুত্র সন্দীপ রায় স্মৃতিচারণায় বলেছেন,সত্যজিৎ নিজে ছবি রিলিজের আগে পোস্টার তদারকি করতে যেতেন,বলে দিতেন কোথায় ভুল। ‘চারুলতা’ র সময় প্রযোজক রিলিজের আগে পোস্টার করে দিতে বলায় তিনি পোস্টারে কালি দিয়ে এঁকে দিয়েছিলেন মাধবী মুখোপাধ্যায়ের মুখ। ‘সোনার কেল্লা’র যোধপুর সার্কিট হাউজে ডাঃ হাজরার টেলিগ্রামে ভারতীয় ডাকের স্ট্যাম্প না থাকায় নিজেই কালো কলম দিয়ে এঁকেছিলেন সেটা। সেটের ডিজাইন,অভিনেতাদের পোশাক,মেক আপ সমস্তটা নিজেই করতেন।বিজয়া রায় লিখেছেন, তারা দুজন নিউমার্কেট থেকে কাপড় কিনে আনতেন সিনেমার আগে আর সেই দিয়ে তৈরী হতো অভিনেতাদের জামাকাপড়। ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-র দুর্গা প্রতিমা সত্যজিৎ নিজেই রঙ করেছিলেন। শিল্পী আসতে দেরী হওয়ায় নিজে রঙ তুলি নিয়ে নেমে পড়েছিলেন মূর্তির সাজের জন্য।এই ছবির টাইটেল কার্ডেও তাঁর শিল্পীকীর্তির ছোঁয়াও পাওয়া যায়। বেনারসে বাড়ীর দেওয়ালে নিজে হাতে লিখেছিলেন টাইটেল।ছবিও তুলেছিলেন,কিন্তু সন্দীপ রায়ের হাতে ঘাট থেকে কেনা বেনারসের ম্যাপ দেখে প্ল্যান বদলে ফেলেন।এইরকম বিবিধ কার্যে পারদর্শী সত্যজিৎ রায় একাধারে ছিলেন দক্ষ সাহিত্যিক।তাঁর সাহিত্যকীর্তি বর্তমানেও শিশু সাহিত্যে শ্রেষ্ঠ স্থান অর্জন করে। চল্লিশ বছর বয়সে প্রথম কলম ধরেন,তাও আবার সন্দেশ পত্রিকার জন্য এবং সেই থেকেই তাঁর খ্যাতি। তাঁর জন্ম শতবর্ষে আজও ম্লান হয়নি। নক্ষত্রমন্ডিত আকাশে উজ্জ্বল চাঁদের মতো প্রকট।
( ক্রমশঃ )