চলচ্চিত্রকার জি অরবিন্দনের দৃষ্টিতে, প্রকৃতির বিভিন্ন দিক ও মানুষের মন যখন একসাথে মিলে যায় তখন তা এক একটি চিত্র হয়ে ওঠে। আর এই জাতীয় চিত্রগুলি যখন আমাদের মুখোমুখি হয়,আর কিছু না হলেও ভীষণভাবে আমরা নৈতিকতার সম্মুখীন হয়ে পড়ি।সিনেমার প্রথম দিকে আমরা দেখতে পাই, কুম্মাট্টি লোকজ ব্যক্তির গল্প বলে, কুম্মাট্টি, দিদা ঠাকুমার গল্পের একটি নিদর্শন, আমাদের কোথাও জীবনের কোনো এক পর্যায়ে গিয়ে যেন বুঝতে হয় জীবনের চেয়েও বড় ব্যক্তিত্ব। এক বিচরণকারী লোক যে বিদ্রোহী, যিনি একটি উপাখ্যান সহ জনপ্রিয় কল্পনাশক্তির Bogeyman হিসাবেও রয়েছেন,একজায়গায় বাচ্চাদের অপহরণ করারও পরামর্শ দেওয়া হয় কিন্তু তা আদপে ঘটে না। আবার কুম্মাট্টি তাদের পিতামাতার কাছ থেকে নিরপেক্ষভাবে বাচ্চাদের এক অদ্ভুত আকর্ষণে টেনে নিয়ে যাবে বিস্তৃত সবুজের ক্ষেতের মধ্যে। সুতরাং এও বলা যায় কুম্মাট্টির আকর্ষণ এবং ক্ষমতা উভয় ইতিবাচক এবং নেতিবাচক। তিনি আশ্চর্য ও ভয়ের কারণও বটে, তাঁর শক্তিগুলি আমাদের বিপরীতে। অন্য কথায়, কুম্মাট্টি একটি অমোঘ চিত্র যা এমন এক পথকে মূর্ত করে তোলে যা বৈষয়িক জগতকে অ-জড়জগতের সাথে সংযুক্ত করে। দৃশ্যমানের সাথে অদৃশ্য জগতগুলিকে তিনি একই সাথে উপস্থিত করেন।অরবিন্দন কুম্মাট্টির ব্যক্তিত্বের জাল এবং ভাঙাগড়ার দিকগুলো খুব সূক্ষ্মভাবে তুলে ধরেছেন যেমন তার নকল দাড়ি, এবং প্রয়োজন মতো শেভ করে আবার নকল দাড়ি পরিধান। এভাবেই তাঁর পরিচয় আমাদের সামনে প্রকাশ করতে সতর্ক থাকে কুম্মাট্টি। একসময় কুম্মাট্টিও অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং তাকে নিরাময় করার প্রয়োজনে সরল বাচ্চারাই ছুটে আসে কোনো এক অমোঘ টানে। আমরা যখন প্রথম কুম্মাট্টিকে পর্দায় দেখি, তখন কেবল দৃশ্যের মধ্যে এক অন্ধকার থেকে দেখানো হয় তাকে, তাঁর গানটি তাঁর রূপের পূর্ববর্তী। কুম্মাট্টির সম্পর্কে আমরা যা জানি, তার বেশিরভাগ অংশ কল্পনাশক্তির থেকে নির্মিত। যেমন গ্রামের লোকেরা সোজা সরল করে এক অপূর্ব মিষ্টতা রেখে গায়। কুম্মাট্টি নিজে যে গান গাইলেন, গভীর, অন্ধকার এবং বিস্তীর্ণ আকাশের মতো নিরাকার, সিনেমার অবিস্মরণীয় গান রচিত হয়েছে কাবালাম নারায়ণ পানিক্করের মাধ্যমে,গেয়েছেনও অত্যন্ত প্রশান্তির সাথে ভক্তিভাবে। না বললেই নয়, শাজি এন কারুনের সিনেমাটোগ্রাফি অনবদ্য। প্রত্যেকটি ফ্রেমে আলোর রঙ তুলি দিয়ে যেন আঁচড় কেটে গেছেন অদ্ভুত অদ্ভুত সব কম্পোজিশনে।
দৃশ্যে দেখি কুম্মাট্টি গ্রামের বাচ্চাদের সাথে বন্ধুত্ব করেন, বাচ্চাগুলি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের,তার কাছে এসবে কোনো ভেদাভেদ নেই। একটি বিশাল শোভাযাত্রার দৃশ্যে, শিশুরা পর্বতজুড়ে তাঁকে অনুসরণ করার সাথে সাথে গীত আকারে লোক রীতিনীতিগুলোকে গায় ও পৌরাণিক কাহিনী স্মরণ করে কুম্মাট্টির সাথে। শিশুদের মন এই যোগাযোগের মাধ্যমে ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয়। অনাবিল আনন্দে কুমাট্টিও মেতে ওঠে তাদের সাথে।কুম্মাট্টিকে প্রগতিশীল দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্ডন(একটি বাচ্চা)-র মা একজন “পাগল মানুষ” বলে আখ্যা দিয়েছেন এবং কুম্মাট্টির সাথে সময় কাটাতে নিরুৎসাহিত করেছেন । নিশ্চিত হওয়া যায় যে, আধুনিকতা এবং অগ্রগতির একটি সমালোচনা রয়েছে, যেমনটি আমরা বুঝতে পারি যে ছবিতে, প্রায় শেষের পর্বে যেখানে কুম্মাট্টি শিশুদের এমন প্রাণীতে পরিণত করেছেন যাদের(পশু-পাখি)মুখোশ নিয়ে তারা খেলছিল। মানব শিশুরা ময়ূর, একটি হাতি, বানর, কুকুর ইত্যাদিতে পরিণত হয়, আধুনিকতার সমালোচনা তখনও অব্যাহত থাকে যখন চিন্ডন নামক ছেলেটি কুকুরে পরিণত হয়েছিল ও ধনী পরিবার তাকে প্রথমে দেখতে পেয়ে ধরে আনে আর গলায় অন্যান্য বিদেশী কুকুরগুলোর মতোই বেল্ট বেঁধে দেয়। লোকঐতিহ্যের মধ্যে প্রাণী মুখোশগুলি পৌরাণিক, বিশ্বে নৃতত্ত্ববিদদের মতে টোটেমিজমে এরকম মান্যতা আছে যে প্রাণীর আত্মা হয়। বাচ্চারা মুখোশগুলোকে খেলনা হিসাবে দেখতো। এরপর বাচ্চারা প্রাণীর মতো মুখোশ পরে খেলতে লাগলো আর খেলনাগুলো টোটেম হিসাবে অন্তর্নিহিতভাবে রূপান্তরিত হলো, অস্বাভাবিকভাবে এই মুখোশগলো জীবন্ত সত্তায় পরিণত হয়।আচার-অনুষ্ঠান, সম্প্রদায়, দুর্বোধ্য এবং অজানা এবং অদৃশ্যরা চলচ্চিত্রের চূড়ান্ত দৃশ্যে একত্রিত হয়।একটি পরিবারের সংকীর্ণ ঘরোয়া ট্র্যাজেডিতে একমাত্র পুত্র কুকুরে রূপান্তরিত হয় বলে সাম্প্রদায়িক আচারের রীতিনীতিও শুরু হয়ে যায়।পুরোহিতরা রূপান্তরগুলি বিপরীত করার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু কোনও ফলসই হয়নি। কুম্মাট্টি একা রূপকগুলিকে বিপরীত করতে পারে কারণ কুম্মাট্টি স্থবির গ্রামের আচারের অংশ নয়, যা আধুনিকতার মতোই অর্থহীন। কুম্মাট্টির শক্তি হ’ল আরেকটি অদৃশ্য,নিরাকার ও অজানাক্রম, আকাশ ও বৃষ্টির ক্রম ও বজ্রের ক্রম। যা অনেক বেশি খোলামেলা ও সরল। এটি শিক্ষণীয় যে এক বছরে কুম্মাট্টি চলে গিয়েছিল এবং চিন্ডান কুকুর হিসাবে তার পশুর অস্তিত্বে বেঁচে ছিল।কুম্মাট্টির গল্পে পুরাতন গল্পের ভাণ্ডার ছিল, দিদাটিও মারা গেছেন একসময়।তাঁর স্মৃতিও একসাথে মলিন হতে হতে একসময় ক্ষয় হয়ে গেছে। অবশ্য চিন্ডনের কুকুরের মতো হয়ে যাওয়া একটি পরিবারের ও সম্প্রদায়ের ক্ষতি হিসাবে ধরা হয়। পরিবার ও সম্প্রদায় শোকে পাথর হয়ে যায়,তাদের লোকসানে যাদু এবং কুম্মাট্টির শক্তিতে বিশ্বাস করতে হয়। অদৃশ্য শক্তিতে বিশ্বাস করতে হয়। চলচ্চিত্রের চূড়ান্ত রূপকগুলির মাধ্যমে আমরা এই রূপান্তরের অর্থ বুঝি। আবার কুম্মাট্টির ফিরে আসায় ছেলেটি মানুষ হয়ে ফিরে প্রত্যাবর্তন করে, খাঁচার পাখিকে তার ছিন্নমূলে ফিরে যাওয়ার জন্য মুক্ত করে দেয় বাচ্চাটি। আকাশে উড়ে যেতে দেখি। প্রায় কিছু সময় আমরা আকাশে পাখি ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাই না, পর্দার একদিক থেকে অন্য দিকে আকাশে নিজের স্বাধীনতায় পাখির ওড়া বাদ দিলে কিছুই নেই, যেমন আবার বাচ্চাদের কোরাস গান শোনা যায়।
পাখির উড়ান স্বাধীনতার একটি সাধারণ রূপকের চেয়ে অনেক বেশি।স্বাধীনতার পথহীন ক্রম।আমরা প্রায়ই বাস্তব সময়ে পাখির এলোমেলো উড়ানের প্রতি আমাদের মনোযোগ দি না, অনেকেই আমরা প্রতিদিনের রুটিনের অংশ হিসাবে প্রকৃতিতে উড়ন্ত পাখিদের দেখি না। তবে সময়ের শুরু থেকেই পাখিরা কোনও নির্দিষ্ট পথ ছাড়াই আকাশে উড়ে চলেছে। তারা এটাই করে। চারদিক ভালোভাবে দেখে বুঝে এরা নিজেদের গতিতেই চলে।এই সাধারণ এবং গুরুতর সত্যটি সিনেমার দর্শকদের কাছে এক নৈতিক প্রতিশ্রুতি,যেটি অরবিন্দন তাঁর চোখ দিয়ে প্রত্যক্ষভাবে উপস্থাপন করে গেছেন।
লেখক পরিচিতি : শুভ্রা সাহা
(জয়েন্ট এডিটর,রিসাইটাল স্ফেরিকাল )