আফ্রিকান মুখোশ ও আধুনিক শিল্পে তার প্রভাব

Share This Post

মুখোশের মুখ নেই,তারা তবু কথা বলে। মুখোশের বিবিধ ব্যবহারের ধারা প্রাচীনকাল থেকেই প্রবহমান। প্রায় বহু হাজার বছর। আফ্রিকা, উত্তর আমেরিকা, মেক্সিকো প্রভৃতি অঞ্চলের আদি জনগোষ্ঠীর মধ্যে এর ব্যবহার ছিল মূলত  ধর্মবিশ্বাসকে কেন্দ্র করে। আবার কোথাও মানুষের মাথার খুলির সঙ্গে নানা উপাদান যোগ করেও মুখোশ তৈরি হয়।

যুগ যুগ ধরে এই মুখোশের মাধ্যমে মানুষ  সৃষ্টি করেছে তার ভাষা, নৃত্য,নাট্য ও চিত্র। বয়ে চলেছে বহু বর্ণময় সংস্কৃতির চিরলোকায়ত স্রোতধারা। তাই মুখোশ এমনই এক ছদ্মবিভঙ্গ।

নৃতত্ববিদদের মতে, মানুষের জন্মও এই আফ্রিকাতেই বলে গণ্য করা হয়। আর এই মানুষের মুখের আদলেই তৈরী হয় মুখোশ। আবিষ্কার বা মুখোশের জন্ম  নিয়ে বিভিন্ন মতভেদ রয়েই গেছে।তবে মুখোশের মাধ্যমে বহু চেনামুখ হয়ে ওঠে অচেনা।

আফ্রিকাতে  বিভিন্ন ধরনের মুখোশের ব্যবহার রয়েছে। মুখোশগুলো মূলত ধর্মভিত্তিক। এগুলো ধর্মীয় ভাব ও গাম্ভীর্যের সঙ্গে ব্যবহার হয়। মুখোশগুলো দক্ষ শিল্পীরা তৈরি করেন। বিশেষ দক্ষতা, আধ্যাত্মিক চেতনা ও প্রতীকী ভাবমূর্তির জন্য তা আরো সুন্দর হয়ে ওঠে। চিরাচরিত নান্দনিক সৌন্দর্য এখানে উপেক্ষিত হয়। মুখোশ গুলো বড্ড প্রিমিটিভ,সরল,সাধারণ।

উদাহরণ :

ডিজল: এই মুখোশ সিয়েরা লিওনের সময়কাল থেকে নৃত্যশিল্পের অঙ্গ  হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

নুনা: এটি  বিভিন্ন প্রাণীকে উপস্থাপন করে। আফ্রিকার বুর্কিনা ফাসোর মানুষেরা নুনাকে ধ্বংসের প্রতিবাদের প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করে।

শিল্পে প্রভাব :

পিকাসো তাঁর ছবিতে কিউবিজ্মের সঙ্গে নিজস্ব স্টাইল জুড়ে নিরীক্ষা শুরু করলেন। এক সময় আফ্রিকান মুখোশ দেখে ভীষণ অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। বিখ্যাত ছবি লে দ্যমোয়াজেল দা’ভিয়ঁ (Les Demoiselles d’Avignon) এ সময়ই আঁকা।  আফ্রিকান মাস্ক-এর প্রভাব ছবিতে স্পষ্ট। ছবিতে তাদের মুখচোখশরীর প্রচলিত দৃষ্টিতে এমনভাবে ‘বিকৃত’, ছবিটি দেখে একসময় অনেকেই বলতে শুরু করেছিলেন, পিকাসোর প্রতিভা নষ্ট হয়ে গিয়েছে।

এখন  বিশেষজ্ঞদের মতে এটা পিকাসোর সর্বশ্রেষ্ঠ ছবিগুলির একটি। সেই সময় ছবিতে এই ধরনের সৌন্দর্যিক বিকৃতি অন্য কেউ আনতে পারেননি।

জিলোট তার ‘লাইফ উইথ পিকাসো’ বইতে  লিখেছেন :

‘Men had made those masks and other subjects for a sacred purpose, a magic purpose, as a king of mediation between themselves and the unknown hostile forces that surrounded them, in order to overcome their fear and horror by giving it a form and an image. At that moment I realized that this was what painting was all about. Painting isn’t an aesthetic operation; it’s a form of magic designed as mediation between this strange, hostile world and us, a way of seizing power by giving form to our terrors as well as our desires. When I came to that realization, I knew I had found my way.’

মরিস ভদ্মামিঙ্ক  (Maurice Vlaminck) এবং অন্দ্রে দেরাঁ (Andre Derain) র কাজে আফ্রিকান শিল্প বিশেষতঃ মুখোশের প্রভাব স্পষ্টতঃ দেখা যায়। ১৯০৬ সালের শুরুর দিকে একটি প্রদর্শনী থেকে দেরাঁ আফ্রিকার গ্যাবন দেশের একটি ‘ফ্যাং মুখোশ’ (Fang Mask) কেনেন। সেইসময় বিভিন্নভাবে আফ্রিকার আর্টের প্রভাব এসে পড়ে প্যারিসের তরুণ শিল্পীদের মধ্যে হয়তো বা নৃতত্ববিদদের আফ্রিকাতে ঘোরার সুবাদেই। মুখোশ কেনার পর কিছুদিনের মধ্যে মাতিস বেড়াতে যান আলজেরিয়ায়। সেখানে আফ্রিকার বিভিন্ন ভাস্কর্য এবং ‘মুখোশ’  তাকে আকর্ষণ করে। তবে বেশিরভাগ লোকের কাছেই মাতিসের আফ্রিকা-আবিস্কার প্রায় অজানা থেকে গেছে। এরপর আলজেরিয়া ভ্রমণের পর মাতিসের আঁকার ধরণ ধীরে ধীরে বদলাতে শুরু করে।সেই প্রভাব এসে পড়েছিল মাতিসের  Nude by the sea চিত্রকর্মে, যেখানে আমরা দেখি  কালো রঙের দেহের অবয়ব স্পষ্ট করে তোলা হয়েছে। এই ছবিতে দাঁড়ানোর ভঙ্গিটি কাঠের স্থির ভাস্কর্যের মতো- অবিকল পশ্চিম আফ্রিকার দাঁড়ানো কালো কাঠের নারী মূর্তি। ‘স্ট্যান্ডিং নুড’এর আরেকটি প্রদর্শন। এখানে ট্রাইবাল আর্ট, যেটা ছিল কাঠের বা প্রস্তর মূর্তি, তাকে রূপান্তরিত করা হয়েছে ছবির ভাষায়- রঙে ক্যানভাসের মধ্যে। ভাস্কর্য ও মুখোশ এভাবেই ইউরোপীয় আধুনিক চিত্রকলায় প্রবেশ করে।

পল ক্লী-র চিত্রকর্মেও বিশেষ করে আফ্রিকার লোকজ শিল্পের প্রভাব প্রবলভাবে অনুভূত হয়।  পল ক্লীর চিত্রে প্রাচীন নৃগোষ্ঠীর মতো করে হাতে আঁকা ‘প্রিমিটিভ’, চিহ্ন, জ্যামিতিক আঁকিবুঁকি ও নকশা ‘ইউরোপ’ থেকে আসেনি। রেনেসাঁ-উত্তর চিত্রকলার কোনো শিল্পগত ঐতিহ্যেই এ রকম চিহ্ন বা প্রতীকের চর্চা হয়নি।  উঠে এসেছে আফ্রিকার লোকজ-শিল্পের গভীরতা থেকে। মদিগিলানীর চিত্রশৈলীতেও এই প্রভাব অভাবনীয়।

বলা যায় এই আদিম দেশ অনেক শিল্পী ও  আধুনিক সভ্যতার ধারাকে প্রভাবিত করে চলেছে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে।আমরা পেয়েছি নিত্য নতুন শিল্পধারা,যা আফ্রিকার এই সাদামাটা মানুষগুলোর মতোই  সহজ ও সাবলীল।

(ক্রমশঃ)

তথ্যসূত্র : ইন্টারনেট ও অন্যান্য বই

Share This Post

Subscribe To Our Newsletter

Get updates and learn from the best

More To Explore

Do You Want To express your thoughts

drop us a line and keep in touch