ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ ও আধ্যাত্মসাধক : ঋষি অরবিন্দ

Share This Post

আমরা সকলেই জানি ১৫ আগস্ট মানেই ভারতের স্বাধীনতা দিবস। অথচ একই দিনে জন্মগ্রহণ করেছিলেন একজন ভারতীয় বাঙালি যে রাজনৈতিক নেতা, আধ্যাত্মসাধক এবং দার্শনিক বটে। যার ইতিহাস থেকে আমরা অধিকাংশ অজ্ঞাত। স্বাধীনতার উচ্ছাসে যে ইতিহাসগুলো আমাদের স্পর্শ করতে পারেনি এটি তার মধ্যে অন্যতম।

 সাল ১৮৭২, পশ্চিম বাংলার হুগলি জেলায় কোন্নগরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন শ্রী অরবিন্দ। প্রাচীন  ঘোষবংশে অরবিন্দ’র জীবনের ছক বেঁধে দিয়েছিলেন তাঁর পিতা কৃষ্ণধন ঘোষ। অথচ সময়ের তরী মানুষকে কোথায় ভাসিয়ে নিতে যেতে পারে বলা মুশকিল। অরবিন্দর পিতা ইচ্ছে তুলিতে অরবিন্দর জীবন আঁকতে চেয়েছিলেন অন্যরকম-অন্যভাবে। কিন্তু পিতা কৃষ্ণধন আদৌও কি সফল হয়েছিলেন পুত্র অরবিন্দর জীবন নিজের মত করে আঁকতে?

কৃষ্ণধন ঘোষ ছিলেন তৎকালীন বাংলার রংপুর জেলার জেলা সার্জন। কৃষ্ণধন ঘোষ বিলেতের কিংস কলেজে চিকিৎসা শাস্ত্রে লেখাপড়া করেছিলেন। তাঁজে ইংরেজি পন্থা প্রবলভাবে প্রভাবিত করেছিল। ফলে তাঁর পুত্রও যেন সেই পন্থায়  নিজেকে বড় করে তুলতে পারে এবং ভারতীয় প্রভাব থেকে দূরে থাকতে পারে তাঁর যথাতথা ব্যবস্থা করেছিলেন। অরবিন্দকে এবং তাঁর দু’ই ভাইকে দার্জিলিং-এর লোরেটো কনভেন্টে স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষার জন্য পাঠানো হয়। এবং ভবিষ্যতে তাঁদের উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে পাঠিয়ে দেয় তাঁদের পিতা কৃষ্ণধন ঘোষ।

বিদেশে গ্রীক, লাতিন এবং ইংরেজি সাহিত্য চর্চা করবার পড় তাঁর পিতার ইচ্ছে মত আইসিএস কর্মকর্তা-র পদে নিয়োগ হবার জন্য পরিক্ষায়ও বসেন। পরিক্ষায় উত্তীর্ণ হন তবে ঘোড়া দৌড়ের পরিক্ষায় স্বেচ্ছায় যান নি কারণ পিতা কৃষ্ণধনের প্রতিটি চিঠি তাকে ভাবিয়ে তুলছিল। ভারতীয়দের প্রতি ব্রিটিশদের অত্যাচার মেনে নিতে পারেনি কাজেই অরবিন্দ ভাবনাচিন্তা পথ ঘুরে যায়। তাঁর চিন্তাভাবনায় জন্ম নেয়— সে ব্রিটিশদের সেবা অথবা কাজ কোনটাই করতে চায় না। কাজেই অরবিন্দ ১৮৯৩ সালে ১৮ বছর বয়সে ভারতে ফিরে আসে তাঁর বিদেশি শিক্ষা পূর্ণ করে। সেই বছরই মহাত্মা গান্ধী তাঁর ২৫ বছর বয়সে আইনবিদ্যা পড়বার জন্য পৌঁছে যায় দক্ষিণ আফ্রিকা। এবং সেই বছরই স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর ৩০ বছর বয়সে শিকাগো শহরে একটি ধর্মীয় সমারোহে উপস্থিত ছিলেন।

কেউ বিপ্লবী অরবিন্দ আবার কেউ ঋষি অরবিন্দও বলে আমরা তাঁকে চিনি। অরবিন্দ বারোদার তাঁর কর্মজীবন শেষ করে বাংলায় ফিরে আসেন। এবং ভারতে ফেরবার পর থেকেই বিদেশিদের প্রতি অনীহা অনুভব করেন। ১৮০৬ সালে রাষ্ট্রিয় শিক্ষা পরিষদের নির্মাণ হয়। সুরেন্দনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিপিনচন্দ্র পাল, রাসবিহারী ঘোষ যারা মিলে তৈরি করেছিলেন এই পরিষদ। এবং অরবিন্দ সেই পরিষদে যোগদান করেন। এখন এই রাষ্ট্রীয় শিক্ষা পরিষদের জায়গায় যাদবপুর বিশ্ব বিদ্যালয়। কিন্তু এই আন্দোলন শুরু হয় বিদেশি বস্তু ত্যাগ করা থেকে। সাধারণত ওঁরা চেয়েছিল ভারতেই নিজেস্ব শিক্ষা ব্যবস্থা হোক। ফলে ভারত নিজেদের শিক্ষা নিজেই নির্ধারণ করতে পারবে তার ভবিষ্যতের প্রজন্মের জন্য। এইভাবেই ভারতের এক একটি করে দিক ভারত নিজের কাছে ফিরে পাবে। এবং শিক্ষা ছিল তার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। এই প্রথম পদক্ষেপ ছিল আন্দোলনের একটি অংশবিশেষ।

দীর্ঘদিন বিদেশে থেকে শিক্ষাগ্রহণ করার ফলে তিনি জানতেই বিদেশিদের ভাবনাচিন্তা সম্বন্ধে। ফলে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে শুধু কথার মাধ্যমে নয় আন্দোলন ছাড়া ভারতকে উদ্ধার করা সম্ভব নয়। শিক্ষায় পরিবর্তন অংশবিশেষ হলেও প্রয়োজন ছিল আরও গভীরেভাবে এই আন্দোলনের সাথে যুক্ত হওয়া। তাই অরবিন্দ ঘোষ কংগ্রেস আন্দোলনের সাথে যুক্ত হন।  এবং বুঝতে পারেন শুধু ভারতীদের মনে কলমের মাধ্যমে সহজে পৌঁছে যাওয়া যেতে পারে। বাংলায় প্রকাশিত হল “বন্দেমাতরম” পত্রিকা। তখন বাংলা বিভাজন আন্দোলন চলেছে। তাঁঁর বৈপ্লবিক চেতনা থেকে তিনি বলছেন— India of the ages is not dead nor has she spoken her last creative word; she lives and has still something to do for herself and the human peoples.

তাঁর এই ভাবনা এবং ভারতের সাধারণ মানুষদের নিয়ে দেখা স্বপ্ন তিনি তাঁর বিপ্লবের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন। মানুষকে উন্নত করার জন্য তার গোড়ার দিকটা মজবুত করার কথা তিনি বরাবার ভেবেছেন। তার প্রতিচ্ছবি পড়েছে তাঁর গোটা জীবন জুড়ে। সেই দেশের ভাবনাই তো আসলে সাধারণ মানুষের ভাবনা। এই ভাবনা ভবিষ্যতে গিয়ে মানুষের চেতনার কথা ভাবিয়ে তোলে। রামকৃষ্ণ পরমহংস অথবা বিবেকানন্দ তাঁর উপর প্রভাব ফেলেছিল। দীর্ঘদিন তিনি ভারতের উপনিষদ পড়েছেন। মানুষের প্রতি যে ভালবাসা এবং যে কর্তব্যর পথ দেখিয়েছে —গীতা।

তাই অরবিন্দ বলছেন — Spirituality is indeed the master key of the Indian mind; the sense of the infinitive is native to it.

তাঁর কংগ্রেসে যোগ দেওয়ার দীর্ঘদিন পর, ১৯০৭-এ কংগ্রেসের সুরাট অধিবেশনে দলের নরমপন্থী অংশের সঙ্গে অরবিন্দ সহ অন্যান্য চরমপন্থী নেতাদের মতবিরোধ শুরু হয়। সেই সুত্রে কংগ্রেস বিভক্ত হয়ে যায় এই মতবিরোধেরর কিছুদিন পরেই। অরবিন্দ অবশ্য ততদিনে কলকাতায় ‘অনুশীলন সমিতি’ নামে দল গঠন করেন। এবং সহিংস সংগ্রামে বিশ্বাসী গুপ্ত সংগঠনগুলির নেতৃত্ব দিতে শুরু করেছেন। এবং আন্দোলন চলা কালীন ক্ষুদিরাম বসু এবং প্রফুল্ল চাকী মুজাফফরপুরে ভুল করে দু’ই ব্রিটিশ মহিলার হত্যা করে ফেলে। ফলে ব্রিটিশ সরকার ৩৭ জন বিপ্লবীদের বন্দী করা হয় তার মধ্যে অরবিন্দ ঘোষও ছিলেন। বিপ্লবীদের জেলে নিয়ে যাওয়া হয়। আলিপুর প্রেসিডেন্সি জেলে অরবিন্দ ঘোষ পুরো এক বছর বন্ধী ছিলেন। ৫ মে ১৯০৮ থেকে ৬ মে ১৯০৯ পর্যন্ত। এই দীর্ঘদিন থাকাকালীন তাঁর মধ্যে অমোঘ পরিবর্তন দেখা যায়। অরবিন্দ চেয়ে ছিলেন জেলে একাকী সময় কাটাবেন। কাজেই সব বিপ্লবীদের থেকে তাঁর সেলটি আলাদা করে দেওয়া হয়। জেলে থাকাকালীন অরবিন্দ নীরব স্বভাবের হয়ে গিয়েছিলেন;ভাবের ঘোরে ডুবে থাকতেন। নিজের খাওয়ার পিঁপড়ে, আরসোলা, টিকটিকিদের খাওয়াতেন। সেই সময় তার শরীরময় লাল পিঁপড়েদের যাওয়া আশা শুরু হত। অথচ তাঁর কোন মধ্যে কোন অস্থিরতার দ্যাখা মিলত না। পশুপাখিদের দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়তেন। অরবিন্দ তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন, “জেলে থাকার সময় আমি অবিরাম শুনতে পেতাম স্বামী বিবেকানন্দের বাণী। যখন আমি এক পক্ষকাল ধ্যানমগ্ন ছিলাম একা একটি কুঠুরিতে, বিবেকানন্দ যেন রোজ আমার সঙ্গে কথা বলতেন।” পরে অরবিন্দ ঘোষ, নলিনীকান্ত গুপ্ত এবং বারীন ঘোষ -এর হয়ে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ আদালতে তাঁদের হয়ে লড়েছিলেন। অবশেষে তাঁরা নির্দোষ প্রমাণিত হয়।

১০০ বছর পর সেই অরবিন্দ’র সেলটি এখন মন্দির হিসেবে শ্রী অরবিন্দর পুজো করা হয়। অরবিন্দ’র সেলটিতে সারারাত বাতি জ্বলে এবং সকালে সেখানে অরবিন্দ’র পুজো দেওয়া হয়। সেলটি শুধুই ভক্তি নয় শিল্পের এক বিশাল মন্দিরও বটে। আবৃত্তির ওয়ার্কশপ, আঁকার ক্লাস, ফুটবলের ক্লাস এবং নাটকের মহড়াও করানো হয়। বিশিষ্ট সাহিত্যিক নবনীতা দেবসেন সেখানে একটি অনুষ্ঠানের অতিথি হয়ে এসেছিলেন। এবং অনুষ্ঠানের অবশেষে নবনীতা দেবসেন প্রায় ৩০ মিনিট ধরে অরবিন্দ’র মূর্তির সামনে প্রণাম করেছিলেন। শুধু বিপ্লবী হিসেবে নয় আধ্যাত্মিক জগতের এক স্বর্ণ ছিলেন। যে বিচার এবং একাত্ম বোধ মানুষের মধ্যে জাগরুক করতে চেয়েছিলেন তাঁর বীজ পুঁতেছিলেন তাঁর জেল জীবনকালীন।

জেল থেকে ফিরে এসে কলমের মাধ্যমে বিপ্লব প্রতিনিয়ত করে চলেছিলেন অরবিন্দ। ইংরেজিতে কর্মযোগী এবং বাংলায় ধর্ম নামের দু’টো পত্রিকার প্রকাশ করেছিলেন অরবিন্দ। এবং পত্রিকাটি চালিয়ে যাওয়ার জন্য সাহায্য করেছিলেন স্বামী বিবেকানন্দর শিষ্য সিস্টার নিবেদিতা। ভবিষ্যতে দু’টি পত্রিকার দায়ভার সিস্টার নিবেদিতা’র হাতে দিয়ে আধাত্মের সন্ধানে ঋষি আরবিন্দ পৌঁছে যান পন্ডিচেরীতে। সেখানেই তার ধর্ম এবং আধাত্মকে নিয়ে চর্চা শুরু করেন।

অরবিন্দ পন্ডিচেরি থেকে শুধু ধর্ম চর্চা নয় সঙ্গে ভারতের স্বাধীনতার জন্য বিপ্লবীদের জন্য লিখে গেছেন অনেক চিঠি। প্রতিনিয়ত তিনি বিভিন্ন ভাবে পথ বাতলে দিয়েছেন বিপ্লবীদের। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অরবিন্দের জন্য লিখেছেন বেশ কিছু কবিতা। এবং ঠাকুর তাঁর অসুস্থতা অমান্য করে পৌঁছে গেছিলেন পন্ডিচেরীতে বিপ্লবী বা ঋষি অরবিন্দ’র কাছে।

বাকিটা জীবন শ্রী অরবিন্দ থেকে গেলেন পন্ডিচেরিতে। একটা সময় পর কথা বলা বন্ধ করে দিলেন মানুষের সাথে। তাঁর সাথে থাকতে আসা শ্রী মা একমাত্র মানুষের সাথে তাঁর যোগাযোগের মাধ্যম ছিল। শ্রী অরবিন্দ তাঁর আধ্যাত্মের জ্ঞান লেখার মাধ্যমে প্রকাশ করতেন। আর্য — পত্রিকার মাধ্যমে তাঁর বহু আধ্যাত্মিক চেতনার কথা সাধারণ মানুষ জানতে পেরেছে। ঋষি অরবিন্দ ইংরেজি এবং বাংলায় বেশ কিছু বই লিখেছেন। Savitri — বিশ্বখ্যাত বইয়ে অরবিন্দ ২৪ হাজার পংক্তি লিখেছেন। যা বিশ্বের সব থেকে বড় কবিতা। ভবিষ্যতে তাঁর সাধনা এবং তাঁর আধ্যাত্মিকতা তাঁকে শ্রী অরবিন্দ নামে পৃথিবীর সাথে পরিচয় করায়। পন্ডিচেরীতে নির্মাণ হয় অরবিন্দ আশ্রম। ৫ ডিসেম্বর ১৯৫০ সালে বিদ্রোহী বা ঋষি অরবিন্দ পৃথিবী ছেড়ে শূণ্যর কাছে চলে যান। রেখে যান আধ্যাত্ম এবং জীবনের বিশাল পরিভাষা। 

অরবিন্দের পিতা চেয়েছিলেন তাঁর ছেলে একটি সরকারি চাকরিজীবী হোক।কিন্তু অরবিন্দ খুঁজে পেয়েছিল জীবনের মূল পরিভাষা। পরিচয় হল মাটির সাথে— এই বাংলার সাথে। ভারতের জন্য যে শিক্ষা ব্যবস্থা কতটা গুরুত্বপূর্ণ এবং ভবিষ্যতে স্বাধীন ভাবনার জন্য উচিত শিক্ষার ব্যবস্থা করতে পেরেছিলেন অরবিন্দ ঘোষ। শুধু পেশীবলে নয় কলমের শক্তি দিয়েও সংগ্রাম করে গেছেন দূরে থেকেও। তাঁর জীবন আমাদের শুধুই দেশের প্রতি কর্তব্য জন্য নয় বরং সমানুপাতিক ভাবে নিজের আত্মার খোঁজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেছেন। ১৫ আগস্টের এই উচ্ছাস ভরা স্বতন্ত্র নিশ্বাসের পিছনে কত হাজারো এমন বাস্তব লুকিয়ে আছে। সেই সব বাস্তবের কাছে আমাদের শরণাপন্ন হতে হবে। বুঝতে হবে জীবনবোধকে শ্রী অরবিন্দ’র মত মানুষের লেখনীর কাছে বসতে হবে। পড়তে হবে তাঁর জ্ঞান সমারোহ। কীভাবে আমাদের জীবন এবং তার আষ্টেপৃষ্টে লেগে থাকা দৈনন্দিন বিপ্লবের সঙ্গে নিজের খোঁজও গুরুত্বপূর্ণ তারই পথ দেখালেন এই বাংলার ঋষি অরবিন্দ। আমাদের জন্য অরবিন্দ তাঁর জীবন অভিজ্ঞতা থেকে লিখে গেছেন — To listen to some devout people, one would imagine that God never laughs.

লেখক পরিচিতি : বিশ্বরূপ হাওলাদার

(পেশায় লেখক ও লিরিক্সিস্ট)

Share This Post

Subscribe To Our Newsletter

Get updates and learn from the best

More To Explore

Do You Want To express your thoughts

drop us a line and keep in touch