ফোনটা বেজে উঠতেই চমকে ঘুম ভেংগে উঠে বসলো রোহান। ফোনের স্ক্রিনে সুমিতের নামটা দেখে,একটু অবাকই হলো রোহান। রাত প্রায় 3টে বাজে,এত রাতে সুমিত কেন ফোন করছে?ফোন টা ধরতেই রোহান শুনতে পেলো,থতমত খাওয়া গলায় সুমিত বলছে,”ভাই,ভাই আমাকে বাঁচা,রঞ্জন ফিরে এসেছে, ও আমাকে ছাড়..ছাড়বে না ভাই,তুই প্লিজ তাড়া- তাড়াতাড়ি আয় ভাই…।“
একটানা কথা গুলো বলেই,ফোনটা কেটে গেলো। রোহান কী করবে বুঝতে না পেরে কিছুক্ষন থম মেরে বসে রইলো । রঞ্জন ফিরে এসেছে?কিন্তু তা কীকরে সম্ভব?গতবছর ওরা যখন সিকিম ট্যুরে গেছিল,সেবারই তো একটা এক্সিডেন্ট এ…!!! পাহাড় থেকে প্রায় 300 ফুট নিচে যখন রঞ্জনের রক্তাক্ত ছিন্নবিচ্ছিন্ন দেহ টা পেয়েছিল ওরা,তখন আর করার কিছুই ছিল না।
…
কিন্তু তাহলে এখন সুমিত এসব কি বললো?রঞ্জন ফিরে এসেছে!!না না, তা কীকরে সম্ভব??ধুস!! আর – আর যদি সত্যি সত্যিই ফিরে এসে থাকে?তাহলে? ও কী পুলিশ সঙ্গে নিয়ে…।
আর ভাবতে পারে না রোহান। কোনরকমে জামা প্যান্ট পরেই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে রোহান। গাড়িতে এসি চলছে,তবুও কেমন যেন ঘামে ভিজে যাচ্ছে রোহান। হঠাৎ লুকিং গ্লাসে চোখ পড়তেই চমকে উঠলো ও!!একি??এটা কীকরে সম্ভব?পিছনের সিটে বসে আছে রঞ্জন!!সারা মুখ রক্তে ভিজে,সারা জামা প্যান্ট রক্তে ভেসে যাচ্ছে।চমকে উঠে রোহান পিছনে ঘুরতেই দেখলো,জায়গাটা খালি। পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখ মুছে আবার গাড়ি স্টার্ট করল রোহান।কিছুক্ষন পর হঠাৎ পিছন থেকে শব্দ এলো –
-কীরে? ভয় পেলি বুঝি?
ঠাণ্ডা হিমশীতল গলার স্বর। চমকে আবার রোহান পিছনে ঘুরতে যাবে,এমন সময় আবার সেই গলা ভেসে উঠলো। যে অবস্থায় আমায় ছেড়ে গেছিলি,পিছনে তাকাস না,সহ্য করতে পারবি না হয়তো!!রোহান কাঠের পুতুলের মতো স্টিয়ারিং এ হাত রেখে বসে রইলো। পিছনে ঘুরবার সাহস আর হলো না,ওদিকে না তাকিয়েই রোহান বললো,
-কিন্তু ভাই,তুই এখানে কি-কীকরে?..মানে,তুই তো সেবার পাহাড় থেকে পড়ে..
কথা শেষ হয়না রোহানের,পিছন থেকে আওয়াজ আসে,
– পড়ে গিয়ে? নাকি ফেলে দিয়ে..?
– এই মানে.. এসব-এসব কী বলছিস ভাই আবোল তাবোল..
হাসার চেষ্টা করে রোহান। কিন্তু ব্যাক সিট থেকে আসা তীক্ষ্ণ গম্ভীর কিন্তু শান্ত কণ্ঠস্বরের কাছে রোহানের হাসিটা,ফিকে শোনায়।রোহান বলে উঠলো,
– দেখ ভাই,সিকিমে যা হয়েছিল সেটা তে- সেটাতে আমি জড়িত ছিলাম না ভাই..আমায় সুমিত ভয় দেখিয়েছিল,বলেছিল,আমি যদি ওকে সাহায্য না করি,তবে ও সানায়ার বাড়িতে আমার আর সানায়ার সম্পর্কের কথা জানাজানি করে দেবে। তুই তো জানিস ভাই,ওর বাড়িতে কিছুতেই আমাকে মেনে নেবে না…
– ব্যাস? শুধুমাত্র এই একটা কারণের জন্য…? আমরা না বন্ধু ছিলাম..? ভাই ডেকেছিলাম তোকে? তার প্রতিদান এভাবে দিলি?
রঞ্জনের গলার তীক্ষ্ণতায় ক্ষোভ স্পষ্ট। রোহান কেমন যেন ঘোরের মধ্যে তলিয়ে যাচ্ছে,জড়ানো গলায় বলল,
– ভাই বিশ্বাস কর, আ- আমি চাইনি, সত্যিই বলছি..
– ছাড় ভাই,তোর সত্যি মিথ্যে তে,এখন আর কিছুই যায় আসেনা,তোদের কে এর ফল ভুগতে হবে..প্রথমে সুমিত,তারপর…
হঠাৎ এক তীব্র আলোর ছটায় আর হর্নের শব্দে সম্বিত ফিরলো রোহানের। সামনে চেয়ে দেখলো একটা ট্রাক,অতিকায় দানবের মত এসে…
থতমত খেয়ে খাটের উপর উঠে বসলো রোহান। স্বপ্ন?হ্যাঁ,স্বপ্নই বটে। সদ্য ওঠা সূর্যের আলো জানলা দিয়ে এসে খাটের ওপর পায়ের কাছে এসে পড়ছে। হাত দিয়ে ঘাম মুছে উঠে পড়ল রোহান বিছানা ছেড়ে।
আধ ঘণ্টা পর ফ্রেশ হয়ে এসে ফোনটা হাতে নিতেই, আরেকবারের জন্য চমকে উঠলো সে। রাত আড়াইটা নাগাদ আসা একটা মিসড কল এর নোটিফিকেশন দেখাচ্ছে মোবাইলের স্ক্রিনে। সুমিতের নম্বর। কাপাকাপা হাতে রোহান ডায়াল করলো নাম্বার টা…বেশ কয়েকবার রিং হলো,কিন্তু কেউ রিসিভ করল না। এবার ভয়ের বদলে রোহানের রাগ হলো একটু। কি অপদার্থ ছেলে রে বাবা! মাঝরাতে ফোন করলো!!আর এখন ফোন ধরছে না??গায়ে একটা জামা গলিয়ে রোহান গাড়ি নিয়ে বেরোলো। সুমিতের বাড়ির সামনে হালকা ভিড় দেখে,গাড়িটা সাইডে পার্ক করে,হেঁটে এগিয়ে গেলো ভিড়টার দিকে। ওকে দেখেই কান্নায় ভেঙে পড়লেন সুমিতের মা,
-দেখ না বাবা.. ছে- ছেলেটা কাল রাতে তোর বাড়ি যাবে বলে বেরোলো,আর রাস্তায় একটা ট্রাকের সাথে একসিডেন্টে…
কাঁদতে কাঁদতে কতকিছু বলে চলেছেন মহিলা,একটা কিচ্ছু রোহানের কানে পৌঁছল না,ওর মাথার মধ্যে বাজছে গম্ভীর কিন্তু তীক্ষ্ণ এক কণ্ঠস্বর…
-এখন আর কিছুতেই কিছু যায় আসেনা..তোদের কে এর ফল ভুগতে হবে,প্রথমে সুমিত,তারপর…
তারপর কি?তারমানে কি রোহান কেও সুমিতের মত….।
সৌভিক দাস।
মহারাজা মনিন্দ্র চন্দ্র কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র।