রাত তখন প্রায় পৌনে দশটা।বাবার কাশির ওষুধটা শেষ হয়ে যাওয়ায়,রমানাথ বাবু অগত্যা বের হলেন কাফ সিরাপ টা আনতে। বাবা রতিকান্ত বাবু একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। বর্তমানে তিনি অবসর প্রাপ্ত । পেনশন এর কটা টাকা, আর ছেলে রমানাথ বাবুর পোস্ট অফিসের পিয়ন এর চাকরির ওই কটা টাকায়,সংসার চালিয়ে ওঠা যখন এক রকম দায় হয়ে পড়েছে,তখনই রমাকান্ত বাবুর এমন মারণ অসুখ ধরলো।রমানাথ বাবুর বাড়িতে বৃদ্ধ বাবা,মা,স্ত্রী ও বছর দশের এক ছেলে নিয়ে সংসার।বলা বাহুল্য,একেবারেই অভাবের সংসার।সংসারের খরচ,ছেলের পড়াশোনার খরচ এসব নিয়ে কিভাবে তিনি চালাবেন,এই সব ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ এরই মধ্যে একদিন রতিকান্ত বাবুর রোগটা বাড়াবাড়ি পর্যায়ে উঠলো।অক্সিজেনের মাত্রা কমতে শুরু করলো রক্তে হঠাৎই।ডাক্তার বললেন,বাড়িতে সব সময় অতিরিক্ত অক্সিজেন সিলিন্ডার এর ব্যবস্থা রাখতে হবে। যে বাড়িতে নুন আনতে পান্তা ফুরায়,সেখানে নাকি বাড়তি অক্সিজেন সিলিন্ডার এর ব্যবস্থা!!কিন্তু বাবাকেও যে বাঁচাতে হবে!! এসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে রমানাথ পৌঁছলেন ওষুধের দোকানে।প্রয়োজনীয় ওষুধ আর কাফ সিরাপ এর শিশি টা নিয়ে,পকেটে থাকা শেষ একশো টাকার নোট টাও দিয়ে দিলেন।এর পর কিভাবে কী করবেন এসব নিয়ে ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক ভাবে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎই তার সাথে ধাক্কা লাগল একটি বছর চব্বিশের ছেলের। ফোনে বেশ উত্তেজিত ভাবে কথা বলতে বলতে যেতে গিয়ে হয়তো ছেলেটি খেয়াল করেনি রমানাথ বাবুকে।ধাক্কা লেগে রমানাথ বাবুর হাত থেকে ওষুধের প্যাকেট টা পড়ে যেতেই, কাচের শিশি ভাঙার মৃদু আওয়াজে চমকে উঠলেন দুজনেই।চরম হতাশায় সেখানেই বসে পড়লেন রমানাথ বাবু।এবার তিনি কী করবেন?ডুকরে কেঁদে উঠলেন তিনি।রাস্তার মাঝেই বসে নিজের কপাল চাপরাচ্ছিলেন,এমন সময় সেই আগন্তুক ছেলেটি তার কাছে এসে বললে…
- মাপ করবেন কাকাবাবু।আসলে কিছু মেডিক্যাল ইমারজেন্সি নিয়ে কথা বলতে বলতে অন্যমনস্ক হয়ে গেছিলাম।
অতঃপর রমানাথ বাবুর হাতের প্লাস্টিকের দিকে চেয়ে ছেলেটি বললো,
- এ বাবা,কাকাবাবু,আপনার ওষুধের শিশিটা তো ভেঙে গেছে,আসুন আসুন,আমি নতুন ওষুধ এর ব্যবস্থা করছি।
সেই ছেলেটিই রমানাথ বাবু কে প্রায় একরকম জোর করেই নিয়ে চললো।ওষুধ গুলো নতুন করে কিনে দিয়ে ওষুধের ব্যাগ টা রমানাথ বাবুর হাতে দিতেই রমানাথ বাবু বললেন,
- ইয়ে মানে,আমার কাছে তো টাকা…
- আরে ধুর!!টাকা কে চাইছে কাকাবাবু আপনার থেকে?আপনাদের কে সাহায্য করাই তো আমাদের কাজ।চলুন আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দিই।
রমানাথ বাবু আর কিছু বললেন না।চুপ করে হাঁটতে থাকলেন।পথে যেতে যেতে ছেলেটির সাথে নানা কথা বার্তায় রতিকান্ত বাবুর অসুস্থতার কথা জানিয়ে ফেললেন।ছেলেটি সব শুনলো,কিছু বললো না।
বাড়ি ফিরে ওষুধগুলো স্ত্রীর হাতে দিয়ে রমানাথ বাবু গেলেন হাত মুখ ধুতে। যাঃ এটা কি করলেন তিনি?যে ছেলেটি এত সাহায্য করলেন,তাকে ধন্যবাদ দেওয়া তো দূর,তিনি তার নামটুকু জানতে চাইলেন না?একটা খারাপ লাগা ঘিরে ধরলো তাকে।রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়লেন।
- কাকাবাবু?কাকাবাবু?শুনছেন??বাড়িতে আছেন?
পরের দিন সকালে পরিচিত এক গলার স্বরে ঘুম ভেঙে গেল রমানাথ বাবুর।তাড়াতাড়ি করে উঠে তিনি দরজা খুলে বাইরে এসে দেখলেন,কালকের সেই ছেলেটি।সঙ্গে আরও দুটি লোক,তাদের কাধে দুটি অক্সিজেন সিলিন্ডার!!অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন রমানাথ বাবু ছেলেটির দিকে।ছেলেটি রমানাথ বাবুর ভাব বুঝতে পেরে হালকা হাসি মুখে বললো,
- কাল আপনার কাছে মেসোমশাই এর কথা শুনে,সারারাত ঘুমোতে পারিনি কাকাবাবু।তাই সক্কাল সক্কাল হাজির হলাম।
- হ্যাঁ কিন্তু বাবা…
- নাহ কাকাবাবু,এসবের বিনিময়ে কোনো টাকা পয়সা লাগবে না।বরং একটু আশীর্বাদ করবেন,যেন এভাবেই মানুষের পাশে থেকে তাদের সাহায্য করতে পারি…
রমানাথ বাবু ছেলেটির মাথায় হাত রেখে বললেন,
- বেঁচে থাকো বাবা…
ছেলেটি হাসি মুখে রমানাথ বাবুকে প্রণাম করে বেরিয়েই যাচ্ছিল,রমানাথ বাবু জিজ্ঞেস করলাম,
- আচ্ছা বাবা,তোমার নামটা তো বললে না?
ছেলেটি হাসিমুখে বললো,
- দেবতাংশু লাহিড়ী।
বলেই বেরিয়ে গেল ছেলেটি।রমানাথ বাবু মনে মনে বললেন,সত্যিই,দেবতার অংশই বটে…।।
সৌভিক দাস
মহারাজা মনিন্দ্র চন্দ্র কলেজ এর সাংবাদিকতা ও
গণজ্ঞাপন বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র।।