জীবনের সমস্ত ব্যস্ততা, ভয়, আঘাত, অতীত ও তার পিছুটান ফেলে যদি মুহূর্তের জন্যে নির্জনে একাকী দাঁড়ানো যায়, তাহলে আপনার হাতে দেওয়া হবে এক ভাবনার চাবিকাঠি। যে চাবিকাঠি আপনার জন্য আগেই এক বিশেষ পরিস্থিতি তৈরি করে রেখেছে। সেই পরিস্থিতি অনুযায়ী আপনি আপনার শৈশবের সেই সব দিনগুলো কাটাচ্ছেন। যে দিনগুলো ভবিষ্যতে আপনার স্মৃতিকে বিষিয়ে তুলবে। সেই পরিস্থিতি অনুযায়ী আপনার জীবনের দুই মেরু অর্থাৎ আপনার মা-বাবা হঠাৎ নিজেদের সম্পর্কের বিভাজন টেনেছে। আপনার বয়স তখন মাত্র পাঁচ বছর। আপনি সবে মাত্র এই বিশাল পৃথিবীকে বুঝতে শুরু করেছেন। তখন আপনি জানতে পারলেন আপনার বিখ্যাত পিতা আর আপনার সাথে থাকবেন না। আগামী দিনগুলো আপনি কাটাবেন আপনার মায়ের সাথে। এ-বয়সে আপনার অনুভূতি প্রকাশ করার মতো ভাষার সন্ধান তখনও আপনি খুঁজে পাননি। অথচ আপনি নিজেকে প্রকাশ করতে চান। এই বয়সে আপনাকে বোঝার মতো বন্ধু পাওয়া অসম্ভব। তাই শুধুমাত্র একটা বন্ধু! যে আপনার থেকে বয়সে অনেক বড়। আর শুধু তাই নয় সমসাময়িক ভাবে সে আপনার পিতারও বন্ধু। এই দুঃসময়ে সেই বন্ধু একদিন আপনার উদ্দেশ্যে একটা গান লিখল। যে-গান আপনাকে ভেঙে পড়তে বারণ করছে বারবার ,জীবনের কাছে আশাহত হতে বারণ করেছে, যে গান আপনি ছোটবেলায় বহুবার শুনেছেন। এখন অনেকগুলো দশক পেরিয়ে গেছে, পৃথিবীর বুকে গানটা চূড়ান্ত খ্যাতি পেয়েছে। যে গান শুধুমাত্র আপনার উদ্দেশ্যে আপনার কঠিন সময়ের জন্য তৈরি করা হয়েছিল। সেই গানটা এখন গোটা পৃথিবীর মানুষ গায়। লক্ষাধিক কন্ঠ একই সুরে সুর মেলায়। সময়ের সাথে আপনার বয়স বেড়েছে, এখন আপনি বড় হয়েছেন। ছোটবেলায় যে-গান আপনার সব দুঃখ কষ্ট ভুলে গিয়ে আগামী সুন্দর দিনের স্বপ্নের কথা ভাবতে শিখিয়েছিল আপনার একমাত্র বন্ধু। সেই গান জ্ঞানে-অজ্ঞানে মানুষ আপনার উদ্দেশ্যে এখনও গাইছে। সবাই আপনাকে জীবনের মূলস্রোতে থেকে যেতে বলছে। সবাই বলছে — Hey Jude, don’t make it bad / Take a sad song and make it better. একবার ভেবে দেখুন তো আপনি কে?
Hey Jude — পল ম্যাককার্টনি গানটা লিখেছিল জন লেননের সন্তান Julian Lennon -এর জন্যে। জন লেননের দু’টো সন্তান। প্রথম স্ত্রী Cynthia Lennon -এর থেকে Julian Lennon আর দ্বিতীয় স্ত্রী Yoko Ono -র থেকে Sean Lennon। ১৯৬৮ সালে, যখন জুলিয়ানের বয়স মাত্র পাঁচ তখন সিনথিয়া আর লেননের সম্পর্কের ইতি টানে জন লেনন। সময়টা লেনন পরিবারের জন্য অন্যতম কঠিন সময় ছিল। তখন লেননের জীবনে সদ্য ইয়োকো ওনো এসেছে। আর আগামী দু’বছরের মধ্যে বিটেলস্ও ভেঙে যাবে। এই কঠিনতম সময়ে পলের মনে হয়েছিল, যতই হোক বন্ধুর পরিবার, এই সময় যদি ওদের পাশে দাঁড়ানো যায়। জুলিয়ানের সাথে একটু কথা বলা খুব দরকার। কী ভাবছে জুলিয়ান! পল ভাবছে কী বলে কথা শুরু করবে জুলিয়ানের সাথে? ভাবতে ভাবতে পল প্রায় এক ঘন্টা ড্রাইভ করে পৌঁছে যায় জুলিয়ানের কাছে। এছাড়া পল বাচ্চাদের খুব ভালোবাসত। সুতরাং জুলিয়ানের পিতা লেননের থেকে বেশি ভালো বন্ধুত্ব ছিল পলের সাথে। অনেক বেশি সময় কাটিয়েছে দু’জনে এক সাথে। বাবা লেননের থেকে পলের সঙ্গে কাটানো মুহূর্তগুলো জুলিয়ানের স্মৃতিতে অনেক বেশি গেঁথে আছে। তাই এমন একটা মুহূর্তে পল জুলিয়ানের কাছে না গিয়ে কীভাবে থাকতে পারে!
পল জুলিয়ানের কাছে যাওয়ার সময় ভাবছিল কী বলবে তাঁর ছোট্ট বন্ধু জুলিয়ানকে! পলের মাথার মধ্যে ঘুরছিল — ঠিক আছে জুলস্! তোমার মা-বাবার বিচ্ছেদ হচ্ছে। আমি জানি তোমার খারাপ লাগছে। কিন্তু চিন্তা করো না, সব ঠিক হয়ে যাবে। তখনই পল নিজের মনে দু’টো লাইন গায় — Hey Jules – don’t make it bad, take a sad song, and make it better…’
পল সাধারণত ড্রাইভ করার সময় রেডিও অফ রাখত, যদি কোনো গান মাথায় হুট করে চলে আসে। Hey Jude —গানটা পুরোপুরি জুলিয়ানকে ভেবেই লেখা। গানে Hey Jules-কে বদলে পল Hey Jude করে দেয়। Oklahoma সিনেমার একটা চরিত্রের নাম ছিল Jude। এই নামটা পলের খুব পছন্দের, তাই নাম বদল করে নাম রাখল — Hey Jude।
সেদিনর মতো দেখা করে পল ফিরে আসে। তারপর Cavendish-এর বাড়িতে গানটা পুরোপুরি ভাবে তৈরি করে পিয়ানোতে। সাধারণত জন আর পল দু’জনে মিলে একসাথে গান লিখত। কিন্তু এই গানের ক্ষেত্রে পল একাই গানটা লেখে এবং সুর করে।
সেই সময় যখন পল গানটা লিখছিল এবং গাইছিল তখন কাকতালীয় ভাবে জন আর জনের দ্বিতীয় স্ত্রী ইয়োকো ওঁর সাথে দেখা করতে আসে ওঁর Cavendish -এর বাড়িতে। পল তখন উপরের ঘরে বসে গানটা শেষ করার চেষ্টা করছে। পল গান গাইছে দেখে লেনন চুপচাপ পলের ডান কাঁধের পাশে এসে দাঁড়ায়, তখন পলের মাথায় একটা লাইন খেলা করে আর সে গায় — ‘The movement you need is on your shoulder’। তারপর পল ফিরে তাকায়। দেখে জন আর ইয়োকো দু’জনেই পিছনে দাঁড়িয়ে আছে। পল বলে— ‘এই লাইনটা বদলে দিই। ভালো লাগছে না।’ কিন্তু জন বলে —’ না! রেখে দাও ভালো লাগছে লাইনটা। মানানসই!’ এই গানের ক্ষেত্রে জন লেননের অবদান এইটুকুই। তবে এখনও যখন পল এই গানটা গায় ঠিক এই লাইনটায় এসে পুরোনো স্মৃতিগুলো তাজা হয়ে ওঠে। জনের কথা খুব মনে পড়ে পলের। দুঃখ পায় পল; জন পৃথিবী থেকে খুব তাড়াতাড়ি হারিয়ে গেছে।
জন লেনন একটা ইন্টারভিউতে বলেছিলেন— ‘যখনই আমি গানটা শুনি, মনে হয় গানটা আমার ছেলের জন্য নয়, আমার জন্যে লেখা। যেমন Hey Jude— যেন বলছে ‘Hey John’ তারপর যখন এই লাইনটা — ‘go out and get her’ শুনে মনে হয় পল আমাকে যেতে দিতে চাইছে না। ওঁর ভেতরের এঞ্জেল বলছে —”যাও তোমার ভালোবাসা ইয়োকোকে নিয়ে আসো!” আবার একই সময় ওঁর ভেতরের ডেভিল বলছে — “আমি আমার প্রিয় বন্ধুকে হারাতে দিতে চাইছি না!’ এটা লেননের ব্যাখ্যা। লেনন আর পলের বন্ধুত্ব ছিল অনেক গভীর। পল লেননকে বেস্টফ্রেন্ড বলত।
গান তৈরি হয়ে গেল, এবার রেকর্ড করার সময়! গানটা রেকর্ডের সময় সাথে ছিল প্রডিউসার মার্ক। রেকর্ড করার সময় ঘটেছিল কিছু মজার ঘটনা। প্রথমে জর্জ হ্যারিসন বলে, গানটার এক-একটা লাইন গাওয়ার পর গীটার তার উত্তর দেবে। অর্থাৎ, একটা লাইন, কিছু গীটার নোটস্, আবার একটা লাইন, আবার কিছু গীটার নোটস্, কিন্তু ব্যাপারটা পলের ভালো লাগেনি। আর পল কোনোভাবে কম্প্রোমাইজ করতে রাজি ছিল না। দুই, রেকর্ড করার সময় দেখা গেল রিঙ্গো ড্রামে নেই। সে রেস্টরুমে গিয়ে বসেছিল। যেহেতু গানে ড্রাম পরে ঢুকছে, তাই ও ঠিক সময়ে এসে ঠিক বাজিয়ে দেয়। গানটা রেকর্ড করা হয় খুব মজা করে। লেননও খুব খুশি হয়েছিল গানটা রেকর্ড করে। এছাড়া লেনন ছিল গানের ব্যাক ভোকালে। এক জায়গায় লেনন ভুল করে “Let her into skin”— বলে ফেলে “Let her under your skin” — এর জায়গায়। লেনন ভুল বুঝতে পেরে রেকর্ডিং-এর মাঝখানেই বলে ফেলে — “Oh! Fucking Hell!” গানের মাঝেই রেকর্ড হয়ে যায় এই বক্তব্য। কিন্তু পরে এডিট করার সময় এটা মুছে ফেলতে ভুলে যায়। রেডিওতে এই ভুলটা এখনও বাজে। Hey Jude — বিটলস্-এর সব থেকে বড়ো সিঙ্গেল গান; প্রায় সাত মিনিটেরও বেশি। ২০০৪ -এ রোলিং স্টোন বলেছে, ‘এখনও ৫০০ গানের মধ্যে ৮ নং স্থানে দাঁড়িয়ে আছে —Hey Jude।’ লেনন বলেছেন,’এই অসাধারণ কম্পোজিশানে আমার কোনও অবদান নেই, কোনো কিছুই বদলানোর প্রয়োজন ছিল না গানের। লাইভে এই গানটার অনেকটা অংশ জুড়ে শ্রোতারাও পারফর্ম করতে পারে। এখনও গানটা মানুষের মধ্যে আত্মবিশ্বাস সঞ্চার করে। মনে হয় এক সাথে সবাই বলছে — “হে জুলস্! ভেঙে পড় না।” সবাই একসাথে পলের সঙ্গে গাইছে — “না না না নানানা!”
১৯৬৮ সালে যে বছর লেননের বিচ্ছেদ হয় Cynthia Lennon-এর সাথে, সেই বছরই Hey Jude রিলিজ করে। গানটা অ্যাপেল মিউজিকে প্রথম বিটলস্-এর সিঙ্গেল ছিল। এই কালজয়ী গানের ইতিহাস যেমন অনবদ্য, ঠিক গানের জীবনও অসীম।
Julian Lennon -এর যে কষ্ট পল ম্যাককার্টনি বুঝতে পেরেছিল, ছুঁয়ে দেখেছিল, সেই ব্যথার জন্য যেটুকু সহানুভূতি পল লিখেছে গানের মধ্যে, সত্যিই এই সৃষ্টি অতুলনীয় ও অমর।
অবশেষে পৃথিবীর বুকে বিটলস্-এর এখন রক্তমাংসের দু’জন জীবিত৷ পল ম্যাককার্টনি আর রিঙ্গো স্টার। দু’জনে এখনও লাইভ পারফর্ম করে চলেছেন। পল লাইভে এখনও Hey Jude পুরো গানটা গায়। চোখ ভিজে ওঠে পলের। পলের মধ্যে বরাবরই ইনোসেন্স ব্যাপার আছে যেটা ওঁর গান গাওয়ার ধরনে ধরা পড়ে। পলের বয়স হয়েছে অথচ শিশুদের সরলতা এখনো ওঁর অঙ্গভঙ্গিতে ফুটে ওঠে। তাই হয়তো পল শিশুদের এতটা ভালোবাসতে পেরেছে, ওদের কষ্ট, দুঃখ ও অপ্রকাশিত ক্ষোভ আঁচ করতে পেরেছে। এক শিশুই বোঝে অন্য শিশুর মন।নয়তো Hey Jude -এর মতো গানের জন্ম কি সম্ভব ছিল?
— বিশ্বরূপ হাওলাদার
(লেখক/গীতিকার/চিত্রনাট্যকার)