শতবর্ষে সত্যজিৎ (শেষ পর্ব)

Share This Post

ভারতীয় নবজাগরণ বা  Indian Renaissance -এ যেমন রামমোহন রায়ের ভূমিকা ঠিক তেমনই উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতেও যদি এই নবজাগরণ বলে কিছু থেকে থাকে তাহলে সেখানে এই রায়চৌধুরী পরিবারের ভূমিকা কিছুই কম না। ঠাকুর পরিবারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তাঁরাও নিজেদের ভূমিকা পালন করেছেন । শুধু উপেন্দ্রকিশোর, সুকুমার বা পরবর্তীতে সত্যজিৎই নয় – এই বৃত্তটা আরও বিশাল। কুলদারঞ্জন, সারদারঞ্জন, প্রমদারঞ্জন, নীতিন বসু, লীলা মজুমদার, সুখলতা রাও, পুণ্যলতা চক্রবর্তী এবং আরও অনেকে। আর শুধু এঁরাই নন এই বাড়ির জামাইরাও সেখানে অংশগ্রহণ করেছেন।সত্যজিৎ “যখন ছোট ছিলাম” গ্রন্থে লিখেছেন, কুলদারঞ্জন ফটোগ্রাফ কালারিং করতেন। এছাড়াও প্রযুক্তির দিক থেকে ফটোগ্রাফ, ড্রয়িং,  হাফটোন ছাপা, এই পরিবারের অবদান চিরস্মরণীয় ।

এই পরিবারের সাহিত্যে অবদান অনস্বীকার্য। প্রধানত শিশু সাহিত্য । উপেন্দ্রকিশোর যখন লিখেছেন ‘ছোটদের রামায়ণ ‘ , ‘বাল্মীকির তপোবন ‘ ইত্যাদি সুগুলি একেবারে ছোটদের জন্য। আবার অন্য দিকে তিনি কঠিন ব্রাহ্ম সংগীতও রচনা করেছেন। আবার ‘টুনটুনির গল্প ‘ যখন লিখেছেন সেই সময় খুব সুন্দর ভাবে লৌকিক গল্প বলেছেন মজার ছলে। দক্ষিণারঞ্জণের’ ঠাকুমার ঝুলি’ থেকে সেটা একেবারেই ভিন্ন । সেখানে যে ভয়ংকর আভাস ছিল সেটা উপেন্দ্রকিশোরে নেই। গল্পের মধ্যে উপদেশ । আবার এই শিশু সাহিত্য নিয়েই যখন সুকুমার চর্চা করেছেন, তাঁর লেখার ধরনে পরিবর্তন এসেছে । সত্যজিৎই বলেছিলেন, সুকুমার রায়ের লেখা একেবারে শিক্ষিত শহুরে বয়স্ক মেজাজ । ‘অবাক জলপান’ -এ যে শব্দের খেলা আছে সেটা মজার হলেও পুরো রসটা শিশুদের নয় । এই যে পরিবর্তন সেটা সত্যজিতের শিশুসাহিত্যেও পাওয়া যাচ্ছে । তবে তাঁর উদাহরণ স্বরূপ ফেলুদা বা শঙ্কুর থেকেও বেশী ‘বারো’ সিরিজের গল্পগুলো বেশি প্রকট । ঠিক যেমন ‘খগম’। এরকম ছোট গল্প বাংলা সাহিত্যে দ্বিতীয় নেই। এমন বীভৎস রস। বালকিষণের হত্যার পর সাধুর গলায় শোনা যাচ্ছে , বালকিষণ আবার ফিরে আসবে। একটা কেউটে গেলে মানুষের মধ্যে থেকে আবার একটা কেউটে ফিরে আসে। মানুষের মধ্যে অসুরত্ব আছে। এটা সত্যজিৎ শিশু সাহিত্যে আনছেন। উপেন্দ্রকিশোর বা সুকুমার যা আনেননি। সত্যজিৎ বারবার এটা করছেন । যদিও তিনি যখন ফেলুদা লিখছেন তখন আবার বলছেন সেটা কিশোর পাঠ্য তাই সেখানে ভয়াবহতা কম দেখাতে হচ্ছে। এই যে গল্পের খাতিরে চেতনার পরিবর্তন সেটাই তাঁর সাহিত্যকে অনন্য করে তুলছে। শঙ্কুর ক্ষেত্রেও এমন বলা যায়। শঙ্কুকে সাইন্স ফিকশন না বলে বরং সাইন্স অ্যাডভেঞ্চার বলা যায় । কারণ শঙ্কুর কোন গবেষণা বা আবিষ্কারের বৈজ্ঞানিক বর্ণনা গল্পে নেই। ফর্মুলা নেই। পদ্ধতি নেই। শুধু তাদের নাম আছে ও আছে তাদের প্রয়োগের ঘটনার উল্লেখ। সত্যজিৎ বারবার দেখিয়েছেন ‘চারুলতা’ ও ‘নষ্টনীড়’ এক নয় । আলাদা । কিন্তু ‘নষ্টনীড় ‘ এর থিমটাই ‘চারুলতা ‘এ আছে। সেটা অক্ষুণ্ণ । এই একি ভাবনা তিনি প্রকাশ করেছেন ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ নিয়ে । তাঁর মতে সেটাই তাঁর সব থেকে প্রাপ্ত বয়স্ক সিনেমা ।

সত্যজিৎকে সারা বিশ্ব একজন ভারতীয় চলচ্চিত্রকার বলে চিনলেও তিনি একাধারে একজন সাহিত্যিক ও শিল্পী । তাঁর দক্ষতা যেমন শিল্পের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে ঠিক তেমনি হয়েছে সাহিত্যের মাধ্যমে । হয়তো তিনি শুধু শিশু সাহিত্য রচনা করেছেন কিন্তু সেখানেও নিজের ভাবনাকে প্রকাশিত করেছেন । বিভিন্ন শিল্প মাধ্যমের যে পার্থক্য, যোগাযোগ,  বিরোধ, আছে এবং মধ্যে যে সূত্র আছে সেটা সত্যজিৎ জানতেন । পরিমিতিবোধ । শতবর্ষেও সেটা অমলিন । তবে শুধু চলচ্চিত্রকার বা সাহিত্যিক সত্যজিৎই জনপ্রিয় । তাঁর শিল্পচেতনা, গ্রন্থচিত্রণ আজ কিছুটা হলেও  বিস্মৃত।

      [শেষ]

Share This Post

Subscribe To Our Newsletter

Get updates and learn from the best

More To Explore

Do You Want To express your thoughts

drop us a line and keep in touch