স্বপ্নচারিণী

স্বপ্নচারিণী

Share This Post

“দালি ইজ ওয়ান অফ দ্য মোস্ট ফান্টাবুলাস অ্যাবসারডিটিস্ট অফ মডার্ন ইউরোপিয়ান আর্ট”- ডানহাতে মার্লবোরো ক্লোভটাই একটান দিতে দিতেই ব্ল্যাকডগের পেগটা বানাতে বানাতে নিজের মনেই অস্ফুটে বলে উঠলো শিঞ্জিনী। কলকাতার শহরতলির বাসিন্দা পেশায় ডব্লিউবিসিএস অফিসার শিঞ্জিনী সেনগুপ্ত ভূমি সংস্কার দফতরে আধিকারিক হলেও তার পছন্দের বিষয় টাকাপয়সা বা জমিজমা নয়। সে ভালবাসে সাহিত্য, তার নেশা হল কবিতা। চারুকলা আর ছবি তোলাও তার অন্যতম প্রধান ভালবাসা। বাড়ি ছেড়ে মাঝে মাঝে কাউকে না জানিয়ে অজানা জায়গায় চলে যাওয়া বারাসত নিবাসী এই সরকারি আধিকারিক ‘অজ্ঞাতবাসে যাচ্ছি’ বলতে একটা তুরীয় আনন্দ অনুভব করে। সেরকমই আজ অজ্ঞাতবাসে এসেছে আজ। পশ্চিম বর্ধমানে বার্নপুর ঘেঁষা দামোদরের ধারে একটা জায়গা আছে নাম কালিপাহাড়ী। সেখানেই আজ সুদূর কলকাতা থেকে গাড়ি চালিয়ে একাই অজ্ঞাতবাসে এসেছে শিঞ্জিনী। দামোদরের ধারেই সরকারি গেস্ট হাউসে উঠেছে সে। কবে বাড়ি ফিরবে তা অবশ্য এখনও ঠিক করেনি আপাত বোহেমিয়ান স্বভাবের শহুরে শিঞ্জিনী। গেস্ট হাউসের লনে বসেই স্কচের বোতল খুলে বসে সে। সঙ্গে মার্লবোরো ক্লোভ। সৌখিন শিঞ্জিনীর  পছন্দের স্কচের ব্র্যান্ড হল ‘ব্ল্যাক ডগ’। কালিপাহাড়ী জায়গাটা মূল খনি অঞ্চল থেকে একটু দূরে। পাশেই দামোদর নদী, ভরা বর্ষায় যার রূপ অনন্য।  বরাবরের পছন্দ এই জায়গাটা তাই তাকে বারবার টেনে আনে শহরের কংক্রিটের জঙ্গল থেকে। মদ আর সিগারেট ছাড়াও শিঞ্জিনী অবশ্য সঙ্গে এনেছে তার অন্যতম প্রিয় চিত্রশিল্পী সালভাদর দালির ‘সিলেক্টেড ওয়ার্কস’। স্প্যানিশ এই চিত্রশিল্পীর সঙ্গে শিঞ্জিনীর কৈশোর অবস্থা থেকেই প্রেম। মূলত সাররিয়ালিজম নিয়ে কাজ করা এই চিত্রশিল্পীর সমস্ত কাজী সাধারণ দৃষ্টিতে আপাত অদ্ভুত। কিন্তু শিল্পপ্রেমী শিঞ্জিনী তাকেই বেছে নিয়েছে নিজের মননের সঙ্গী হিসেবে।

‘ক্যাক ক্যাক, ক্যাক ক্যাক………‘

দামোদরের অপর পাড় থেকে অদ্ভুত শব্দ আসে একটা। নাম না জানা কোনও পাখি ডেকে ওঠে। বেলাশেষে হয়তো বাসায় ফিরছে। দূরে দেখা যাচ্ছে বিহারিনাথ পাহাড়। বর্ষার সময় এসেছে বেড়াতে শিঞ্জিনী। চারদিকে নিস্তব্ধ, জনপ্রাণীর দেখা নেই সরকারি গেস্ট হাউসের আশেপাশে। অদ্ভুত ওই আওয়াজটা শুনে স্বাভাবিকভাবেই বুকের ভিতরটা কেমন ছ্যাঁত করে ওঠে তার।

‘’বেয়ারা! ’’ –

গেস্ট হাউসের কর্মীকে ডেকে ওঠে সে। কিন্তু কোনও সাড়া পায়না। এবারে ভয় পেতে শুরু করেছে সাধারণ মেয়েদের তুলনায় সাহসী। এদিকে সূর্য প্রায় ডুব দেবে পশ্চিম আকাশে। গেস্ট হাউস থেকে প্রায় ৫০০ মিটার দূরে এক সাধুর আশ্রম। কালীর উপাসক এই তান্ত্রিক সন্ন্যাসীর সঙ্গে পরিচয় আছে শিঞ্জিনীর। ঈশ্বরে সেভাবে বিশ্বাসী না হলেও সাধুসঙ্গ করতে চিরকাল ভালবাসে বিজ্ঞানের ছাত্রী শিঞ্জিনী। সেই সাধুর কাছেই সে শুনেছে এই চত্বরে দামোদরের ধারেই বৈষ্ণব সাধকদের একটি সমাধিস্থানের কথা। বহু পুরনো সেটি। নদীর ধার ঘেঁষে প্রায় শখানেক সমাধি রয়েছে সেখানে। বৈষ্ণব রীতি মেনে সোজা করে বসিয়ে রেখে সমাধি দেওয়া প্রায় শখানেক সন্ন্যাসীর কথা ভেবেই আরও ভয় পেয়ে যায় সে।

‘‘এদিকে আয় মা।’’-

এবারে আর পাখির ডাক নয়, খোদ এক গ্রাম্য মহিলা কণ্ঠ। ফের বুকটা ছ্যাঁত করে ওঠে অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় শিঞ্জিনীর। অন্ধকার প্রায় নেমে এসেছে। কাউকে দেখতে পায়না সে। না পেয়ে এবার হাঁটা শুরু করে সে। লন ছেড়ে বেশ কিছুটা এগোলে দামোদরের চর শুরু। যদিও এখন ভরা বর্ষা, তবুও চরের বালি খানিকটা রয়ে গেছে এখনও। সেদিকেই হাঁটা লাগায় সে। কিছুদূর গিয়ে থমকে দাঁড়ায়। সাদা থান পরা এক মহিলার অবয়ব নজরে আসে তার। সেদিকেই মন্ত্রমুগ্ধের ফের চলতে শুরু করে সে।

হাঁটতে হাঁটতে একেবারে চরেই এসে পড়েছে শিঞ্জিনী। অন্ধকার প্রায় নেমে এসেছে। সূর্যের আলোও প্রায় নিবু নিবু। গেস্ট হাউসের লন পার হয়ে চরে এসে পড়লেই বাঁদিকে দেখা যায় বৈষ্ণবদের সমাধিটা। লন পেরিয়ে সে যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে, সেখান থেকে সমাধি পরিস্কার দেখা যায়। তবে এখন অন্ধকার নেমে আসায় অস্পষ্ট সবটাই। পূর্বে নিকটবর্তী সাধুবাবার আশ্রমে এই সমাধি নিয়ে বহু অতিভৌতিক গল্প শুনেছে সে। সেগুলোই মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল তার।

“কই রে মা?”

ফের একবার একই মহিলার গলা। যতদূর নজর যায় সে তাকালো সামনের দিকে, কিন্তু কিচ্ছু নজরে এলোনা। সাহসে ভর করে এবার সামনের দিকে পা বাড়ালো শিঞ্জিনী। অন্ধকার তখন আরও গাড় হয়ে এসেছে। ভরা বর্ষার মাঝেও দামোদরের চরের বালি এখনও কিছুটা রয়ে গেছে। তার উপর দিয়েই মন্ত্রমুগ্ধের মত হেঁটে চলেছে সে। গ্রীষ্মকালে যখন সমস্ত চরাটাই শুকিয়ে আসে তখন দামোদরের একপার থেকে আরেক পারে চলাচল করে মানুষ। নদী কালিপাহাড়ীর এই এলাকায় ভীষণ চওড়া। আর সেই চওড়া চরের মধ্যেী গ্রীষ্মে চলাচল করার জন্য রয়েছে সরু গ্রাম্য পায়ে হেঁটে যাওয়ার মত বালির রাস্তা। টানা বৃষ্টিতে ভিজে স্যাঁতসেঁতে হয়ে রয়েছে সেই রাস্তা। সেই রাস্তা ধরেই হাঁটা লাগালো শিঞ্জিনী। কিছুদূর এগিয়েই প্রায় দামোদরের খাতে এসে পড়লো সে। সামনেই বর্ষার দামোদর। ভরা বর্ষায় ভয়ঙ্কর রূপ তার। কিন্তু যে ডাক শুনে তার এদিকে আসা তার কোনও হদিস সে পেল না। চারদিকে তাকিয়ে বিশেষ কিছু দেখতেও পেল না। অন্ধকার নেমে গেছে পুরোপুরি। বাঁদিকে পিছন করে একটু কোনাকুনি তাকালেই বৈষ্ণব সমাধি। যদিও অন্ধকারে তার প্রায় কিছুই দেখেতে পেলোনা সে। শুধু অন্ধকারে কালো অবয়ব কয়েকটা। ওগুলোই বোধহয় সমাধিগুলো, মনে মনে করলো শিঞ্জিনী। এবার সে ভয় পেতে শুরু করেছে সত্যি সত্যি। ওই রহস্যময় মহিলা কণ্ঠ ছাড়া অন্য কোনও চিন্তাও তার মাথায় আসছে না তার। এটা কি তার হ্যালুশিনেশন  তবে ? নাকি ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখছে সে? ঘুমের ঘোরে হাঁটার কথাটাও তার মাথায় এলো একবার বিদ্যুৎ চমকের মত। শেক্সপিয়রের ম্যাকবেথ নাটকে সে পড়েছে লেডি ম্যাকবেথের ঘুমের ঘোরে হাঁটার কথা। সেখানে লেডি ম্যাকবেথ তার পূর্ববর্তী জীবনের বহু ভয়ঙ্কর ঘটনার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। সেখানে রাজা ডানকান, লেডি ম্যাকডাফ ও লর্ড ব্যাঙ্কোর কথা চিন্তা করতে গিয়ে তার মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে যায়। আর তার ফলেই তার মানসিক সমস্যা থেকে ঘুমের মধ্যে হাঁটা শুরু হয়। ইংরিজিতে তাদেরই বলা হয় ‘সমনামবুলিস্ট’। আধুনিক ইউরোপীয় চিত্রশিল্পের ইতিহাসে বহু শিল্পী পরবর্তীকালে কাজ করেছেন এই ঘুমের মধ্যে হাঁটা ওয়েস্টার্ন আর্টের ভক্ত শিঞ্জিনীর মাথায় এলো সে কথাই। তবে কি সেও লেডি ম্যাকবেথের মত ঘুমের মধ্যেই হাঁটছে এখন। এসব ভাবতে ভাবতেই ঘুমটা তার গেল ভেঙ্গে। দামোদর পারে সকাল হচ্ছে ধীরে ধীরে। নাম না জানা পাখির ডাকেই তার ঘুম ভেঙ্গেছে। এতক্ষণ তবে সে যা দেখছিল সবটাই ছিল স্বপ্ন। বিছানায় হাত-পা ছড়িয়ে বসে ঘুমের রেশ একটু কাটাতেই আগের রাতের কথা মাথায় আসে তার। বিছানা ছেড়ে উঠে বেসিনের দিকে যায় সে ব্রাশ করার জন্য। বেসিনের কলটা খুলে মাথা নিচু করতেই মাথার উপর থেকে একরাশ বালি বেসিনের উপর পড়ে। দামোদরের চর ! বিদ্যুৎ চমকের মত মাথায় আসে কথাটা শিঞ্জিনীর। তবে কি সত্যি স্বপ্নে হেঁটেছিল সে ? ভাবতে থাকে সে।


শিবাজীপ্রতিম

Share This Post

Subscribe To Our Newsletter

Get updates and learn from the best

More To Explore

Do You Want To express your thoughts

drop us a line and keep in touch