শিল্পের মহান ও অনুগত সেবক হিসেবে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের নাম ইতিহাসের পাতায় জ্বল জ্বল করবে, এই কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। কিন্তু ইতিহাস কোনো ছাপা অক্ষরের বই না। ইতিহাস একটা বোধ, যেটা বুঝতে চেতনার প্রয়োজন হয়। সৌমিত্রকে বুঝতে সেই ইতিহাসবোধের প্রয়োজন হয়। একজন তারকাকে ঘিরে যে দেবত্ব তেরি হয়, সেখানে তাঁকে একটা সিংহাসনে বসিয়ে দেওয়া হয়। মানুষ তাঁকে পুজো করে। তাঁর সমালোচনা করে না। কিন্তু এটা ঠিক নয়। এটাকে রিভ্যালুয়েট করা দরকার। তবে তার মানে এই নয় যে তাঁকে অশ্রদ্ধা করা হচ্ছে। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে তিনি মনীষী হয়ে যান। এবং সৌমিত্র হয়েছেন। নির্দ্বিধায়।
বিশ্বম্ভরের প্রয়ানে জলসা ঘর যতটা ফাঁকা হয়ে ছিল তার থেকে অধিক শূন্যতা টালিগঞ্জ পাড়ায়। ঋত্বিক-উত্তম-সত্যজিৎ-মৃণালের পরে সৌমিত্র হয়েছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের মুখ। বাঙালির চলচ্চিত্রের পরিচয়পত্র, ঠিক যেন আইডেন্টিটি কার্ড। এমন একজন বহুমুখী বা ভার্সেটাইল ব্যক্তিত্ব আবার কবে শিল্প পরিসরে আসবে সেটা বলা কঠিন। অপুর সেই বাঁশির সুর আজও অমলিন হয়ে বাজতে থাকে। বাঙালি স্বভাবতই বিভাজন রেখা টানতে অভ্যস্ত। যেমন ঘটি-বাঙাল ঠিক তেমনই উত্তম-সৌমিত্র। শ্রেষ্ঠত্বের দৌড়ে কে এগিয়ে, কার প্রতিভা কতটা সেটা নিয়ে আলোচনা ও তর্ক এইসময় নয় বরং সর্বকালেই অপ্রাসঙ্গিক ও অমূলক। কার শ্রেষ্ঠত্ব কতখানি সেটা মহাকালের হাতে ছেড়ে দেওয়াই শ্রেষ্ঠ। রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন, শিশির ভাদুড়ির নাট্যকর্ম প্রাণহীন। কিন্তু শিশির কুমারের প্রতি সৌমিত্রর আগ্রহ গভীর রবীন্দ্রপ্রেম কমাতে পারেনি। শিল্পরস আস্বাদনের এই নমনীয়তা এক বিরল গুণ।
প্রথম ছবি ‘অপুর সংসার’ করার পর একের পর এক পালক এসে জুটেছিল তাঁর শিরস্ত্রাণে তবে বাঙালি সমাজে তাঁকে সবচেয়ে জনপ্রিয়তা দিয়েছিল হয়তো ‘ফেলুদা’ চরিত্রে একটি সাক্ষাৎকারে সৌমিত্র বলেছিলেন — ‘ I must confess that I had never imagined Felu would become a cult almost overnight after the release of Sonar Kella in 1974. It was only later that *I* managed to convince myself saying this wasn’t a problem after all. In a way, Feluda did make me universally acceptable across Bengali Society. ‘ ফেলুদার আন্তর্জাতিকতাও কিছুটা তাঁর অভিনয়ের জোরেই লাভ করেছে। সত্যজিৎ প্রসঙ্গ না আনলে এই আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। তাঁর একাধিক ছবিতে সৌমিত্র কাজ করেছেন। সৌমিত্রকে সত্যজিতের মনে হয়েছিল ‘ঘরে বাইরে’-র সন্দীপ ও নিখিলেশ,দুইই পারেন করতে কিন্তু পরে সন্দীপ দিয়েছিলেন এই ব্যাখ্যায় যে নিখিলেশের মতো সৎ স্বামীর থেকে বিমলকে সন্দীপের প্রতি টানতে সত্যি সেরকম আকর্ষক শিল্পী প্রয়োজন। ঠিক সেইরকম ভাবে গুপীর চরিত্রে সৌমিত্র চাইলেও তাঁকে সত্যজিৎ নেননি। এমন বহু দৃষ্টান্তমূলক ঘটনাই সৌমিত্রের বৈশিষ্ট্যতা বর্ণনা করে। শুধু চলচ্চিত্রেই নয়, ছোটপর্দাতেও তিনি নিজের কাজের ছাপ রেখে গিয়েছেন। দূরদর্শনে বিভাস চক্রবর্তী পরিচালিত ছয় পর্বের গোয়েন্দা গল্প সিরিয়ালে ফেলুদার চরিত্রে আবার অভিনয় করেন। ‘ঘুরঘুটিয়ার ঘটনা’ ও ‘গোলকধাম রহস্য’। পরবর্তীকালে সন্দীপ রায়ের সাথেও তিনি কাজ করেছেন। তবে সেখানে ফেলুদা নয়, করেছেন অন্য চরিত্র। তাছাড়া থিয়েটার, সৌমিত্রর প্রধান আকর্ষণ জীবনের। সেখানেও তিনি নব যুগের সৃষ্টি করেছেন। যদিও একটা সময় তিনি ফিল্ম নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। ওটাই মূল পেশা হয়ে দাঁড়িয়েছিল কিন্তু তবুও তাঁর মনে হয়েছিল কিছু একটা করার। শিশির ভাদুড়ির পর কমার্শিয়াল থিয়েটার যে মানুষকে আকর্ষণ করতে পারছিল না সেখানে সৌমিত্র একটা বড়ো ভূমিকা পালন করেন। শূন্যস্থান তৈরি হচ্ছিল এবং সেখানে সৌমিত্রর একটা আকাঙ্ক্ষা ছিল। তাঁর মনে হয়েছিল তাদেরকেও থিয়েটারে গিয়ে কিছু করা উচিত। আর সেখান থেকেই সেই সময়ে সৌমিত্রের পেশাদারী থিয়েটারে প্রবেশ। তাঁর পরিচালনায় আসে ‘নামজীবন’। পেশাদার রঙ্গমঞ্চে যে নাটকগুলো হত সেগুলো ছিল অত্যন্ত সাধারণ আর একেবারেই বুদ্ধিদীপ্ত নয়। বিদেশে কিন্তু পেশাদার থিয়েটারের মান দেখলে অবাক হতে হয়। কিন্তু এদেশে সাধারণ মঞ্চে হচ্ছে তাই একটু সহজপাচ্য ও বিনোদনমূলক নাটকই হবে।
যেগুলো নাটক হিসেবে উচ্চস্তরের সেগুলো সাধারণ মঞ্চে ঠাঁই পাবে না। দর্শক নিতে পারবে না। সৌমিত্র প্রথম এই ধারণা ভাঙলেন। ‘নামজীবন’ এক মুহূর্তে আলোড়ন ফেলে দেয়। সেখানে যে জীবন দেখানো হয়েছে সেটা নিয়ে এখানে সেভাবে ডিল করা হয়নি খুব একটা। এভাবেই তাঁর নাট্যজগতে প্রতিষ্ঠা। তাঁর কর্মকাণ্ডের সত্যি সীমা পাওয়া কঠিন। ‘এক্ষন’ -এর মতো এক কৌলীন্যময় পত্রিকার সম্পাদনা করেছেন। কবি ও নিবন্ধকার। কঠোর রাজনৈতিক মতাদর্শ পোষণ করেছেন আমৃত্যু। তিনি সার্থকভাবে একজন অভিনেতা। মঞ্চে ও পর্দায়। তিনি কলকাতার নিজস্ব মার্লন ব্র্যান্ডো। তিনি বাংলার সংস্কৃতি জগতের বিশাল নক্ষত্র ছিলেন। সেই নক্ষত্র পতন হলেও সেই আলো কখনওই নিভে যাবেনা। মহানের কখনও মৃত্যু হয় না। তাঁরা একটি বোধে পরিনত হয়ে যান। সৌমিত্র তাই হয়েছেন। সেই বোধের উপলব্ধি হওয়া প্রয়োজন। শুধু স্মারক পুরস্কার ও বক্তৃতা দিলেই সেটা হয়না। অপর্ণা সেন সেই স্মৃতিতে বলেছিলেন, ” সৌমিত্রর মৃত্যুর পর আর কেউ নেই যার দিকে তাকিয়ে থাকা যায়। তিনি ছিলেন আমাদের শেষ আইকন।”