১৯৫৫ সালের আগস্টের শেষে আর সেপ্টেম্বরের শুরুতে শুধু বাংলা চলচ্চিত্রই নয়, বিশ্বচলচ্চিত্রের পুরো কাঠামো বদলের ঘটনা ঘটে সত্যজিৎ রায়ের কুশলী পরিচালনায়। ১৯২৯ সালে নন্দিত কথাশিল্পী বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত ছবিটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সমাদৃত প্রথম দক্ষিণ এশীয় চলচ্চিত্রের মর্যাদা লাভ করে, যা পরবর্তীতে পরিণত হয় সর্বকালের অন্যতম সেরা চলচ্চিত্রে।
অনীক বড়সড় এক দাও মারলেন অভিনেতা জিতু কমলকে নিয়ে। সিনেপাড়ায় আগে থেকে তেমন কোনো নাম-ডাক ছিল না জিতুর। অভিনয় করেছেন কিছু টিভি সিরিয়ালে, ছোট চরিত্রে। তাই, সত্যজিৎ রায়ের মতো একজন কিংবদন্তির চরিত্রে জিতু কমলকে নির্বাচন করাটা শুরুতে ঝুঁকিরই নামান্তর। কারণ, পান থেকে চুন খসলেই শেষ। সমালোচকদের সমালোচনার অন্ত থাকবে না। ফুঁসলে উঠবে সিনেমা পাড়ার গলি। তবে, জিতু কতটা ঝানু অভিনেতা, এর জবাব তিনি দিয়েছেন অভিনয় প্রদর্শনীতে। সত্যজিতের চিরাচরিত সিগনেচার বা দেহ-ভঙ্গিমা, যেটা আমরা সচরাচর দেখে এসেছি, জিতু কমল সেরকম কিছু ব্যবহারিক প্যাটার্ন রপ্ত করেছেন একেবারে নিখুঁত শৈল্পিকসত্তায়। চাহনির ধরন, স্টাইল, হাতে ধরা সিগারেট, সবকিছু এতটাই ত্রুটিহীন যে, এতে জিতু কমলের প্রচণ্ড খাটুনি, এবং চরিত্রের প্রতি তার ভালোবাসা এবং নিবেদনকেই প্রতিফলিত করে। জিতুকে সত্যজিতের চরিত্রে মেনে নিতে দর্শকের কোনো অসুবিধাই হয়নি।
চিরায়ত বাংলার অপরূপ আনন্দ-বেদনার আখ্যানে যে উপন্যাস রচনা করেন বিভূতিভূষণ, সত্যজিৎ সেলুলয়েডের মাধ্যমে তাকে নান্দনিক সুষমায় উদ্ভাসিত করেন। কাহিনীর সময়কাল বিংশ শতাব্দীর বিশের দশক। স্থান নিশ্চিন্তপূর নামক বাংলার এক প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল। প্রধান চরিত্র অপু ও তার পরিবারের জীবনযাত্রার কথাই পথের পাঁচালী-এর মুখ্য বিষয়।
অপুর বাবা হরিহর রায় নিশ্চিন্দিপুরের পৈতৃক ভিটায় তার নাতিবৃহৎ পরিবার নিয়ে বসবাস করেন। তিনি পেশায় পুরোহিত। আয় সামান্য। লেখাপড়া জানেন। তাই কিছু ভাল যাত্রাপালা লিখে অধিক উপার্জনের স্বপ্ন দেখেন। বাস্তবে তিনি অত্যন্ত ভালমানুষ এবং লাজুক প্রকৃতির লোক। সকলে সহজেই তাকে ঠকিয়ে নেয়। পরিবারের তীব্র অর্থসংকটের সময়েও তিনি তার প্রাপ্য বেতন আদায় করার জন্য নিয়োগকর্তাকে তাগাদা দিতে পারেন না।
হরিহরের স্ত্রী সর্বজয়া তার দুই সন্তান দুর্গা ও অপু এবং হরিহরের দূর সম্পর্কের বিধবা পিসি ইন্দির ঠাকরুণের দেখাশোনা করেন। দরিদ্রের সংসার বলে নিজের সংসারে বৃদ্ধা ন্যুব্জদেহ ইন্দির ঠাকরুনের ভাগ বসানোটা ভাল চোখে দেখেন না সর্বজয়া। সর্বজয়ার অত্যাচার অসহ্য বোধ হলে ইন্দির মাঝে মাঝে অন্য এক আত্মীয়ের বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেন। দুর্গা তার ধনী প্রতিবেশীর বাগান থেকে ফলমূল চুরি করে আনে ও ইন্দির ঠাকরুনের সঙ্গে ভাগাভাগি করে খায়। একদিন, সেই প্রতিবেশীর স্ত্রী এসে দুর্গাকে একটি পুঁতির মালা চুরির দায়ে অভিযুক্ত করেন ও এই চুরির প্রবণতাকে উৎসাহ দেওয়ার অপরাধে সর্বজয়াকে দোষী সাব্যস্ত করেন।
ভাইবোন অপু ও দুর্গার মধ্যে খুব ভাব। দুর্গাও মায়ের মতোই অপুকে ভালবাসে। তবে মাঝেমধ্যে তাকে খেপিয়ে তুলতেও ছাড়ে না। তারা কখনও কখনও চুপচাপ গাছতলায় বসে থাকে, কখনও মিঠাইওয়ালার পিছু পিছু ছোটে, কখনও ভ্রাম্যমাণ বায়োস্কোপ-ওয়ালার বায়োস্কোপ দেখে বা যাত্রাপালা দেখে।
সন্ধ্যাবেলা দু’জনে দূরাগত ট্রেনের বাঁশি শুনতে পেয়ে আনন্দ পায়। একদিন তারা বাড়িতে না বলে অনেক দূরে চলে আসে ট্রেন দেখবে বলে। কাশের বনে ট্রেন দেখার জন্য অপু-দুর্গার ছোটাছুটির দৃশ্যটি এই ছবি’র এক স্মরণীয় ক্ষণ। বাড়ি ফিরে এসে তারা ইন্দির ঠাকরুনকে মৃত অবস্থায় দেখতে পায়।
গ্রামে ভাল উপার্জন করতে সক্ষম না হয়ে হরিহর একটা ভাল কাজের আশায় শহরে যান। সর্বজয়াকে তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়ে যান যে, ভাল উপার্জন হলে ফিরে এসে ভাঙা বসতবাড়িটা সারিয়ে তুলবেন। হরিহরের অনুপস্থিতিতে তাদের অর্থসংকট তীব্রতর হয়। সর্বজয়া অত্যন্ত একা বোধ করতে থাকেন ও খিটখিটে হয়ে যেতে থাকেন। বর্ষাকালে একদিন দুর্গা অনেকক্ষণ বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর বাধায়। ওষুধের অভাবে তার জ্বর বেড়েই চলে ও শেষে এক ঝড়ের রাতে দুর্গা মারা যায়।
এরপর একদিন হরিহর ফিরে আসেন। শহর থেকে যা কিছু এনেছেন, তা সর্বজয়াকে বের করে দেখাতে থাকেন। সর্বজয়া, প্রথমে চুপ করে থাকেন, পরে স্বামীর পায়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। হরিহর বুঝতে পারেন যে, তিনি তার একমাত্র কন্যাকে হারিয়েছে। তারা গ্রাম ও পৈতৃক ভিটে ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। যাত্রার তোড়জোড় শুরু হলে, অপু দুর্গার চুরি করা পুঁতির মালাটা আবিষ্কার করে। সে মালাটা ডোবার জলে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। ছবির শেষ দৃশ্যে দেখা যায়, অপু বাবা-মায়ের সঙ্গে গোরুর গাড়িতে চড়ে নতুন এক গন্তব্যের উদ্দেশ্যে চলেছে।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পথের পাঁচালী বাংলা সাহিত্যের একটি ধ্রুপদী জীবনীমূলক উপন্যাস। ১৯২৮ সালে একটি সাময়িকপত্রে ধারাবাহিকভাবে উপন্যাসটি প্রকাশিত হতে শুরু করে এবং ১৯২৯ সালে পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয় । উপন্যাসটিতে একটি দরিদ্র পরিবারের নিজের গ্রামের ভিটেতে টিকে থাকার লড়াই এবং সেই পরিবারের ছেলে অপুর বেড়ে ওঠা বর্ণিত হয়েছে। উপন্যাসের পরবর্তী অংশে বাবা-মায়ের সঙ্গে অপুর গ্রাম ছেড়ে যাত্রা ও কাশীবাসের কাহিনী রয়েছে, যা সত্যজিৎ রায়ের অপরাজিত নামক পরবর্তী চলচ্চিত্রে দেখানো হয়েছে।
১৯৪৪ সালে সিগনেট প্রেসের চিত্রলেখ নকশাকার হিসেবে কাজ করার সময়, পথের পাঁচালী উপন্যাসটির একটি নতুন অখণ্ড সংস্করণের অলঙ্করণ করার সময় বইটি পড়েন সত্যজিৎ রায়। প্রেসের মালিক ডি. কে. গুপ্ত তাকে বলেন যে, এই বইটি থেকে একটি অসাধারণ চলচ্চিত্র নির্মাণ করা সম্ভব। ১৯৪৬-৪৭ সালে সত্যজিৎ যখন চলচ্চিত্র বানানোর কথা চিন্তাভাবনা শুরু করেন, তখন তিনি এই উপন্যাসের মানবতা ও গীতিধর্মিতার প্রভাবে এটিকে চলচ্চিত্র রূপান্তরিত করার সিদ্ধান্ত নেন। এজন্য কোন আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়নি।
পথের পাঁচালী চলচ্চিত্রের কোন চিত্রনাট্য লেখা হয়নি। সত্যজিৎ রায়ের আঁকা ছবি ও টীকাগুলি থেকে এই চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। তিনি ১৯৫০ সালে লন্ডনের উদ্দেশ্যে সমুদ্রযাত্রার সময় এই সকল নোটগুলো লেখেন। সত্যজিৎ লিখেছেন যে, তিনি চলচ্চিত্রের প্রয়োজনে উপন্যাসের বেশ কিছু চরিত্রকে সরিয়ে দিয়েছিলেন ও গল্পটিকেও কিছুটা রদবদল করেছিলেন। উপন্যাসের শুরুর দিকেই গ্রামের মন্দিরে সকলের সামনেই ইন্দির ঠাকরুণের মৃত্যু ঘটে, কিন্তু চলচ্চিত্রে অপু ও দুর্গা তার মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখে। চলচ্চিত্রের অপু ও দুর্গার ট্রেন দেখার জন্য দৌড়নোর দৃশ্যটিও উপন্যাসে নেই। বর্ষায় ভিজে প্রচণ্ড জ্বর বাঁধিয়ে দুর্গার মৃত্যু ঘটে বলে চলচ্চিত্রে দেখানো হলেও উপন্যাসে মৃত্যুর কারণ অজানাই রাখা হয়েছে। হরিহর রায়ের পরিবারের গ্রাম ত্যাগ দিয়ে চলচ্চিত্র শেষ হলেও উপন্যাস সেই ভাবে শেষ হয়নি।
অপুর চরিত্রে অভিনয় করার জন্য সত্যজিৎ পাঁচ থেকে সাত বছরের শিশুর সন্ধানে সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দেন, কিন্তু কোন বিজ্ঞাপনের মারফত আসা কোন ছেলেকেই তার পছন্দ হয়নি। কিন্তু সত্যজিতের স্ত্রী বিজয়া রায় তাদের বাড়ির নিকটে সুবীর বন্দ্যোপাধ্যায় নামে একটি ছেলেকে লক্ষ্য করেন এবং অবশেষে অপুর চরিত্রে তাকেই পছন্দ করা হয়। ইন্দিরা ঠাকরুণের চরিত্রে অভিনয়ের জন্য সত্যজিৎ কলকাতার নিষিদ্ধ পল্লী থেকে চুনীবালা দেবী নামক একজন পুরাতন নাট্যাভিনেত্রীকে খুঁজে বের করেন। পথের পাঁচালী চলচ্চিত্র নির্মাণ হওয়ার আগেই কানু বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা চলচ্চিত্র জগতের একজন প্রতিষ্ঠিত অভিনেতা ছিলেন। তিনি হরিহর তথা অপুর পিতার ভূমিকায় অভিনয় করেন। সত্যজিতের বন্ধু-পত্নী করুণা বন্দ্যোপাধ্যায় একজন ভারতীয় গণনাট্য সংঘের একজন অপেশাদার অভিনেত্রী ছিলেন। তিনি ছবিতে অপুর মা সর্বজয়া চরিত্রে কাজ করেন। দুর্গার ভূমিকায় অভিনয় করার পূর্বে উমা দাশগুপ্ত কয়েকটি নাটকে অভিনয় করেছিলেন। অন্যান্য বিভিন্ন অনুল্লেখ্য চরিত্রে বড়াল গ্রামের বাসিন্দারা অভিনয় করেন।
ছবির শুরু থেকেই অর্থায়ন একটি বড় সমস্যা ছিল। কোন প্রযোজক এই চলচ্চিত্রে লগ্নি করতে আগ্রহী ছিলেন না। কারণ এতে বড় কোন তারকা নেই। গতানুগতির ব্যবসা সফল ছবির মতো কোন গান ও মারপিটের দৃশ্য নেই। অবশেষে সত্যজিৎ রায়ের পরিকল্পনা শুনে কল্পনা মুভিজের প্রযোজক ভট্টাচার্য বাবু বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিধবা স্ত্রীর সাথে যোগাযোগ করে চলচ্চিত্রের স্বত্ব তাকে দেওয়ার অনুমতি চান এবং চলচ্চিত্রটি সে সময়ের প্রতিষ্ঠিত পরিচালক দেবকী বসুকে দিয়ে পরিচালনা করাতে চান। কিন্তু বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্ত্রী তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। কারণ তিনি ইতোমধ্যে সত্যজিৎ রায়কে চলচ্চিত্র নির্মাণের অনুমতি প্রদান করেছিলেন। ফলে তা সত্যজিৎ রায়ের হাতেই থেকে যায়।
চলচ্চিত্রটির আনুমানিক নির্মাণব্যয় ছিল ভারতীয় ৭০,০০০ টাকা। রানা দত্ত নামে একজন প্রযোজক দৃশ্যধারণ চালু রাখার জন্য অর্থায়ন করেন। কিন্তু তার কয়েকটি চলচ্চিত্র ব্যবসায়িকভাবে ব্যর্থ হওয়ায় তিনি অর্থায়ন বন্ধ করে দেন। সত্যজিৎ রায়কে তাই আরও কিছু দৃশ্য ধারণ করতে ধার করতে হয়, যাতে তিনি সেই দৃশ্যগুলো দেখিয়ে কোন সম্ভাব্য প্রযোজককে সম্পূর্ণ চলচ্চিত্র অর্থায়নে রাজি করাতে পারেন। তহবিল সংগ্রহের জন্য তিনি গ্রাফিক নকশাবিদ হিসেবে তার কাজ চালিয়ে যান, তার জীবন বীমা পলিসি বন্ধক রাখেন এবং তার গ্রামোফোনের রেকর্ডের সংগ্রহ বিক্রি করে দেন। চলচ্চিত্রটির নির্মাণ ব্যবস্থাপক অনিল চৌধুরী সত্যজিৎ রায়ের স্ত্রী বিজয়াকে তার গহনাগুলি বন্ধক রাখতে বলেন। তথাপি দৃশ্যধারণের জন্য তার যথেষ্ট পরিমান অর্থ ছিল না। ফলে প্রায় এক বছর দৃশ্যধারণ বন্ধ ছিল।
এরপর অল্প অল্প করে থেকে থেকে চিত্রগ্রহণ চলে। সত্যজিৎ রায় পরবর্তী কালে স্বীকার করেন যে, এই দেরী হওয়া তাকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছিল এবং তিনটি অভূতপূর্ব বিষয় চলচ্চিত্রটিকে রক্ষা করেছিল: এক) সময় বাড়লেও অপুর কণ্ঠ ভাঙ্গে নি বা বদলায় নি। দুই) দুর্গা চরিত্রে শিশু অভিনেত্রী চোখে পড়ার মতে বড় হয়ে যায়নি। তিন) বয়স্কা ইন্দির ঠাকরুন বাস্তবে মারা যায়নি।
ছবি নির্মাণের সঙ্কুল পরিস্থিতিতে পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিধান চন্দ্র রায়কে সত্যজিৎ রায়ের মায়ের একজন প্রভাবশালী বন্ধু এই চলচ্চিত্র নির্মাণে সহায়তার জন্য অনুরোধ করেন। মুখ্যমন্ত্রী এতে এগিয়ে আসেন এবং সরকারি কর্মকর্তারা চলচ্চিত্রটির ধারণকৃত দৃশ্যগুলো দেখেন। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রচারণা বিভাগ চলচ্চিত্রটি নির্মাণের ব্যয়ের পরিমাণ মূল্যায়ন করেন এবং ঋণ অনুমোদন করেন, যাতে কিস্তিতে প্রদত্ত এই ঋণ দিয়ে সত্যজিৎ রায় নির্মাণ কাজ শেষ করতে পারেন। পশ্চিমবঙ্গ সরকার চলচ্চিত্রের প্রকৃতি বুঝতে পারেনি, তারা ভেবেছিল এটি গ্রামীণ উন্নয়ন সম্পর্কিত কোন প্রামাণ্যচিত্র, এবং ঋণটি এই চলচ্চিত্রের নামে “রাস্তা উন্নয়ন” খাতে নথিভুক্ত করেছিল।
তবে এই চলচ্চিত্রের প্রতিক্রিয়া সমভাবে ইতিবাচক ছিল না। চলচ্চিত্রটি দেখার পর ফ্রঁসোয়া ত্রুফো বলেন, ‘আমি এমন কোন চলচ্চিত্র দেখতে চাই না যেখানে একজন কৃষক হাত দিয়ে খাচ্ছে।’ দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর প্রভাবশালী সমালোচক বসলি ক্রাউদার ১৯৫৮ সালে চলচ্চিত্রটির ধীরে ধীরে বিকশিত মর্মভেদী ও কাব্যিক গুণের প্রশংসা করলেও লিখেন, কাঠামোহীন বা তালিকাহীন গতিসমৃদ্ধ এই চলচ্চিত্রটি হলিউডের চলচ্চিত্র সম্পাদকদের ‘এলোমেলো কর্তন’-এর অংশ হিসেবেও পাস করতে পারতো না।
দ্য হার্ভার্ড ক্রিমজন ১৯৫৯ সালে যুক্তি দেখান যে খণ্ড খণ্ড অংশ হওয়া এই চলচ্চিত্রের সবচেয়ে ‘বড় দুর্বলতা, যা একে অকেজো করে ফেলে, দীর্ঘসময় মনোযোগ ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়।’ ১৯৮০-এর দশকের প্রারম্ভে সংসদ সদস্য ও সাবেক অভিনেত্রী নার্গিস দত্ত ‘দারিদ্র্য রপ্তানি’র জন্য সত্যজিৎ রায়ের সমালোচনা করেন।
২০২০ সালের এপ্রিল নাগাদ রটেন টম্যাটোসে ৪৫টি পর্যালোচনার ভিত্তিতে চলচ্চিত্রটির রেটিং দাঁড়ায় ৯৮%। ওয়েবসাইটটির সমালোচকদের ঐকমত্যে বলা হয় ‘এমন একটি চলচ্চিত্র যাতে একই রকমভাবে ধৈর্য দরকার ও ফল নিয়ে আসে, পথের পাঁচালী পরিচালক সত্যজিৎ রায়কে তার অভিষেকেই ধ্রুপদী কর্ম উপহার দিতে সাহায্য করেছে।’ ২০১৮ সালে চলচ্চিত্রটি বিবিসির সর্বকালের ১০০ সেরা বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র তালিকায় ১৫তম হয়।
পথের পাঁচালী চলচ্চিত্রটির পর সত্যজিৎ রায়ের অপুর জীবনের গল্প নিয়ে আরও দুটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। অপর দুটি ছবি হল অপরাজিত (১৯৫৬) ও অপুর সংসার (১৯৫৯) । তিনটি ছবি একত্রে ‘অপু ত্রয়ী’ নামে পরিচিত। অপরাজিত চলচ্চিত্রে অপুর কৈশোর, গ্রাম্য বিদ্যালয়ে ও কলকাতার কলেজে তার শিক্ষা জীবনের গল্প চিত্রিত হয়েছে। এই চলচ্চিত্রের মূল বিষয়বস্তু হল এক দুর্বলচিত্ত মা ও তার উচ্চাকাঙ্ক্ষী যুবক পুত্রের মর্মস্পর্শী সম্পর্ক। অপুর সংসার চলচ্চিত্রে অপুর প্রাপ্ত বয়স, তার স্ত্রীর অকাল মৃত্যুতে তার প্রতিক্রিয়া ও তার শিশু পুত্রের সাথে তার সম্পর্কের গল্প চিত্রিত হয়েছে। এই দুটি অনুবর্তী পর্বও অসংখ্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার অর্জন করেছিল।
সত্যজিৎ রায়ের শুরুতে এই ত্রয়ী নির্মাণের পরিকল্পনা ছিল না। ১৯৫৭ সালে ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে অপরাজিত গোল্ডেন লায়ন লাভের পর তাকে ত্রয়ী নির্মাণের সম্ভাবনা রয়েছে কিনা এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি ত্রয়ী চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। ২০১৪ সালে কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় অপুর পাঁচালী নামে একটি বাংলা চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন, যাতে পথের পাঁচালী চলচ্চিত্রে অপু চরিত্রে অভিনয় করা সুবীর বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাস্তব জীবনের গল্প চিত্রিত হয়েছে।
পথের পাঁচালী স্বাধীন ভারতে নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র যা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সমাদৃত হয় এবং ভারতকে বিশ্ব চলচ্চিত্রের দরবারে পরিচিত করিয়ে দেয়।
লেখক : উমাশ্রী রায়