সাম্প্রতিক সময়ের বাঙলা ছবিতে সামাজিক বাস্তবতার প্রতিফলন কতটা?

Share This Post

আমরা অনেক সময়েই বলে থাকি যে  ‘ শিল্প সমাজের দর্পণ ‘ । কথাটা সিনেমার ক্ষেত্রে ভীষণভাবে প্রযোজ্য । সিনেমায় যদি খালি চিত্তমনোরঞ্জনের জন্য গালভরা আজগুবি গল্প শোনানো হয় তাহলে সাময়িকভাবে কিছু দর্শক পেলেও খুব তাড়াতাড়ি এধরণের সিনেমা সাধারণ মানুষের কাছেই অপ্রয়োজনীয় আর অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠবে । গত দশ বছরের বাংলা সিনেমার ক্ষেত্রেও সেটাই হচ্ছে ।  

   যদি এটা বলি যে সাম্প্রতিক বাংলা সিনেমায় সামাজিক বাস্তবতার কোন ছাপ নেই তাহলে প্রথমত বলতে হয় সাম্প্রতিক সময়ের সামাজিক বাস্তবতা বলতে আমরা কি বুঝি  ।  সাম্প্রতিক সময়ে সারা দেশজুড়ে ফ্যাসিবাদী রাজনীতির একটা বিপুল উত্থান ঘটেছে । দিনে দিনে সেই ফ্যাসিবাদী রাজনীতির প্রকোপ আরও আরও বাড়ছে , আমাদের জীবনের প্রত্যেকটা ক্ষেত্রে বেড়ে চলছে তার প্রভাব । আমরা সারা দেশজুড়ে মুসলিমদের উপর সামগ্রিক জনমানসে একটা ঘৃণা তৈরি  হতে দেখেছি । দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দেশভক্তির নামে দলিতদের মুসলিমদের নিধন লিঞ্চিং দেখেছি গত ছয় –সাত বছরে । আমরা ভারতমাতার নাম নিয়ে ধর্মের নাম নিয়ে ধর্ষণ দেখেছি , ভারতে বাংলায় হিন্দুত্ববাদের উত্থানের সাথে সাথে হিন্দু আইডেন্টিটিকে কেন্দ্র করে একটা উগ্র পৌরুষের জন্ম হতে দেখেছি আর তার সাথে দেখেছি নারীবিদ্বেষের অভূতপূর্ব রুপ । এই কবছরে নারী নির্যাতন অন্য মাত্রায় পৌঁছেছে । অথচ এই সব সাম্প্রতিক বাস্তবতার কোন ছাপ আমার দেখা কোন বাংলা সিনেমায় পাইনা ।

গত দশ বছরে আমাদের দৈনিক জীবনে সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব ভয়ানকভাবে বেড়ে গেছে , বেড়েছে টিকটকের মত এপের ব্যবহার । আমাদের বাস্তব জীবনের সাথে  সমান্তরালভাবে  একটা ডিজিটাল জীবন এখন চলতে থাকে । এই ডিজিটাল জীবন কোথাও আমাদের বাস্তব জীবনের থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে । কোনও ঘটনা ঘটলে সেটার ছবি বা সেটা সম্পর্কে মতামত সোশ্যাল মিডিয়ায় দেওয়া আর বাকিদের মতামত জানা – এগুলো এখন খুবই স্বাভাবিক আমাদের সবার কাছে । বাংলা সিনেমায় মূলধারায় যে সব সিনেমা হয় , তার অধিকাংশই হয় সম্পর্কের জটিলতা নিয়ে অথবা আজগুবি রিমেক বা থ্রিলার বানানোর চেষ্টা। থ্রিলারের ক্ষেত্রেও বাংলা সিনেমা ভয়ানকভাবে ব্যর্থ । বেশিভাগই হয় হলিউড বা কোরিয়ান সিনেমার জঘন্য কপি অথবা সেই পুরনো ফেলুদা, ব্যোমকেশ , কিরিটীর কাসুন্দি ঘাঁটা । হিন্দি তামিল তেলেগু সিনেমায় কিছু উন্নতমানের থ্রিলার তৈরি হলেও সত্যজিৎ রায়ের পর থেকে একটা এমন থ্রিলার বাঙালী তৈরি করতে পারেনি যা নিয়ে গর্ব করা যায় ।

গত দশ বছরের সামাজিক বাস্তবতার যেমন কোনও ছাপ নেই বাংলা সিনেমায় , তেমনই নেই সাধারণ বাঙালী জীবনের কোনও যথাযোগ্য বাস্তবোচিত চিত্রায়ণ । উদাহরণ হিসাবে বাংলা সিনেমার পরিচিত পরিচালকদের ছবির কথা ধরা যাক । শিবপ্রসাদ নন্দিতা বাংলা সিনেমার জনপ্রিয় পরিচালক । তাদের সিনেমা ‘বেলাশেষে ‘ বা ‘পোস্তো ‘ বা ‘হামি ‘ চিরাচরিত মধ্যবিত্ত জীবনের কিছু সেন্টিমেন্টাল থিমের উপর সুরশুড়ি দিয়ে পেয়ে আসছেন বেশ কিছু দর্শক । তাদের সিনেমায় ভালোবাসা বলতে আবেগঘন কথাবার্তা আর থাকে কিছু মিডিওকার সেন্টিমেন্টকে টার্গেট করে সুন্দর সুন্দর ডায়ালগ , একান্নবর্তী বাঙালী পরিবারের একসাথে ভালোবেসে থাকার গল্প দেখিয়ে দর্শক আনার কিছু সস্তা গিমিক । যদি মৈনাক চক্রবর্তীর সিনেমার কথা বলি , তাহলে তার মধ্যে আধুনিক সমাজে সম্পর্কের বদলে যাওয়া চেহারা দেখানোর চেষ্টাকে সাধুবাদ জানাতে হয় । কিন্তু তা সম্ভব হয় না কারণ সেই সম্পর্কের চিত্রায়ণে কোনও গভীরতা  নেই , শুধু থাকে চরিত্রগুলোর কেঠো নাটকীয় অভিনয় । যদি বিশ্ব সিনেমায় যে কোনও সাম্প্রতিক ভালোবাসার গল্প যেমন  ‘ call me by your name’  বা ‘brooklyn’ বা যেকোনও সিনেমার কথা ধরি, তাহলে জীবনের ভালোবাসার যে নিখুত চিত্রায়ণ পাই তার সিকিভাগও পাই না এই ছবিগুলোতে । সম্পর্কের জটিলতা  নিয়ে এবং কখনও কখনও থ্রিলারঘেঁষা ছবি বানান জনপ্রিয় পরিচালক সৃজিত চক্রবর্তী । মোটা দাগের অভিনয় , কিছু সেন্টিমেন্টে নাড়া দেওয়া গান আর মুহূর্ত আর নীচু মানের যৌন শুরশুরি দেওয়া হিউমার নিয়ে বছরের  পর বছর ছবি বানিয়ে চলেছেন তিনি । এই পরিচালকদের ছবি দেখলে মনে হয় বাঙালীর সামাজিক জীবনে নিজেদের সাজানো গোছানো উচ্চবিত্তের দুনিয়া ছাড়া আর কোনওকিছুই তাদের মনে ধরে না । যখনই তার বাইরে কোনও শ্রেণীর মানুষকে দেখানোর চেষ্টা হয় , সে নিম্ন মধ্যবিত্তই হোক বা নিম্নবিত্ত , তাদের সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা যে পরিচালকদের  নেই সেটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে । এই সিনেমায় ফরসা নায়িকাকে মেক আপ করিয়ে কাজের লোক সাজানো হয় , এখানে নিম্নবিত্ত মানুষজন কথা বলে একটা দো আঁশলা ভাষায় , যেটা বাঙালী মধ্যবিত্তের লোকগান গাওয়ার চেষ্টার মতই কৃত্রিম । নিম্নবিত্ত , নিম্ন মধ্যবিত্ত জীবনের দৈনিক সমস্যার কোনও প্রতিফলন নেই এই সিনেমায় , মধ্যবিত্ত জীবনের চিত্রায়ণও মোটা দাগের অভিনয় আর বছরের পর বছর যে সব সেন্টিমেন্ট বিক্রি করা হয় সেগুলোতে ভর্তি ।

গত দশ বছরের সামাজিক বাস্তবতার  ন্যূনতম প্রতিফলন না থাকায় বাঙালী মূলধারার সিনেমার জনপ্রিয়তা মানুষের কাছেও কমছে – বক্স অফিস কালেকশন থেকে সেটা বারবার স্পষ্ট হয়ে উঠেছে । মানুষ দৈনিক জীবনে যে সমস্ত প্রতিকূলতা বাস্তবতার সম্মুখীন হয় এই সিনেমায় তার ছোঁয়া না থাকায় সাধারণ বাঙালী দর্শক মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে এই ছবি থেকে । অথচ মৃণাল সেনের মত পরিচালক এই বাংলাতেই বছরের পর বছর সমসাময়িক জীবনের সামাজিক-রাজনৈতিক সমস্যা নিয়ে একের পর এক বিশ্বমানের ছবি বানিয়েছেন , সত্যজিৎ রায় শহরের জীবনে মধ্যবিত্ত নিম্ন মধ্যবিত্ত জীবন যাপনের সংকট নিখুঁত ভাবে তুলে ধরেছেন তার সিটি ট্রিলোজিতে , ঋত্বিক ঘটক দেশভাগের পরের ভারতীয় তথা বাঙালী জীবনের বাস্তবতা দেখিয়ে গেছেন তার ছবিতে । তপন সিনহার মত পরিচালকও সামাজিক সমস্যার দিকগুলো তুলে ধরেছেন তার ছবিতে  । তরুণ মজুমদারের মত পরিচালক মানুষের চিত্তরঞ্জন যেমন করেছেন , তেমনই বাঙালী আটপৌড়ে জীবনের খুঁটিনাটি দক্ষতার সাথে তুলে ধরেছেন তার ছবিতে ।

সত্যি বলতে বাংলা সিনেমার ইন্ডাস্ট্রির  এখনকার কাঠামোয় অর্থাৎ টলিউডের ভিতর থেকে এখন সময়োপুযুগী ছবি আশা করাও বৃথা । এক প্রজন্মের প্রোডিউসাররা যখন বিশ্বাস করতে শুরু করেন যে শুধুমাত্র মোটা দাগের জিনিসই ব্যবসা করবে আর তার সাথে পরিচালকরাও যখন শিল্পসত্ত্বা বন্ধক রেখে সেইরকম ছবি বানান তখন সেই ইন্ডাস্ট্রিতে সেটাই নিয়ম হয়ে ওঠে । তাই বাংলা সিনেমার ভবিষ্যৎ এখন নির্ভর করছে এখনকার নতুন প্রজন্মের ইন্ডিপেন্ডেন্ট পরিচালকদের হাতে , যারা পরিচালক হিসাবে নিজের সামাজিক দায়বদ্ধতার কথা মাথায় রেখে ছবি বানাতে চায় , যারা নতুনদের নিয়ে কাজ করতে ভয় পায় না, যারা কন্টেন্ট আর ফর্ম নিয়ে পরীক্ষানীরিক্ষায় আগ্রহী , যারা বিশ্বাস করে যে কোনও ছবির মান তার সাথে রিলিজ হওয়া আগের পরের কয়েকটা ছবির সাথে তুলনা করে ঠিক হয় না , ঠিক হয় ওয়ার্ল্ড সিনেমার নিরিখে , ঠিক হয় সারা পৃথিবীতে সিনেমার শ্রেষ্ঠতম উদাহরণগুলোর সাথে তুলনায় , যারা জানে যে সামাজিক বাস্তবতা থেকে দূরে সরে যাওয়া একজন ফিল্মমেকারের আর তার ছবির মৃত্যুর সমান ।

অরিজিৎ কুণ্ডু

Share This Post

Subscribe To Our Newsletter

Get updates and learn from the best

More To Explore

Do You Want To express your thoughts

drop us a line and keep in touch