শৈশবের সেই দিনগুলিতে যখন আমরা টুনটুনির বই এর গল্প গুলো শুনে হা করে থাকতাম আর মা যাই খাইয়ে দিত সেগুলো টুক করে খেয়ে নিতাম, সেই সময় থেকেই তিনি আমাদের সঙ্গে রয়েছেন। মাঝেমধ্যে তো বাবার কাছে বায়নাও করতাম যে বাবা একটু টুনটুনির গল্প শোনাবে। তখন কি আর জানতাম, এই রত্ন গুলির রত্নাকার উপেন্দ্রকিশোর। আমার সেই ছোট্ট বেলার উপেন্দ্রকিশোর ছোট্ট বেলা হতেই আজও আমার সঙ্গেই থেকে গেল। শুধুই কি টুনটুনি ? গুপি গাইন বাঘা বাইন, ঘ্যাঁঘাসুরও সেই লিস্টিতে আছেন। ছোটোদের রামায়ণ ও মহাভারত অবশ্য একটু বড় বেলাতেই পড়েছি। এগুলিকে ভালোবাসা বললেও ভীষণ কম বলা হবে। আজকের দিনে যেখানে ছোটদের হাঁটার পথ শুরু হয় মোবাইলের ঘেরাটোপের মধ্যে হতে সেখানে আমরা অপেক্ষার দিন গুনতে পছন্দ করতাম পরের দিনের জন্য, যখন আবারও মা গালে ভাত দিয়ে টুনটুনির পরের পর্বটি পড়ে শোনাবেন।
ছোট্ট বেলার আমাদের এই ভালোবাসার অথবা ভালোলাগার এই দূতের জন্ম হয় বনেদি রায় পরিবারে ১২৭০ বঙ্গাব্দের ২৭ বৈশাখ অর্থাৎ ১২ই মে, ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলায় যা আজ কিশোরগঞ্জ হিসাবেও পরিচিত। পিতা কালিনাথ রায় ডাকনাম শ্যামসুন্দর মুন্সির দ্বিতীয় সন্তান ছিলেন উপেন্দ্রকিশোর। তবে একথা অনেকেই জানেন না উপেন্দ্রকিশোর দত্তক নেওয়া সন্তান এবং কমদারঞ্জন রায় ছিল তার পূর্বের নাম। জন্মসূত্রে তার নাম উপেন্দ্রকিশোর না হলেও পিতা কালিনাথ রায়ের জ্ঞাতিভাই হরিকিশোর রায়চৌধুরী তাকে এক প্রকার হোম যজ্ঞ করে দত্তক নেন এবং তার নাম পরবর্তী ক্ষেত্রে রাখা হয় উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুররী । তারা মোট পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে তিন ভাই কুলদারঞ্জন ও প্রমোদরঞ্জন ও উপেন্দ্রকিশোর স্বয়ং ব্রহ্মধর্ম গ্রহণ করেন তবুও তাদের মধ্যে সম্পর্কের কোনো আঁচর দেখা যায়নি। ব্রাহ্ম কথার অর্থ শিশু-কিশোরদের মনকে আলোকিত করা উজ্জ্বল করা দীপ্ত করা এবং চারপাশের জগৎ সম্পর্কে তাকে অবহিত করা এই সকল চিন্তাভাবনাকে নিয়েই এই ব্রহ্মধর্ম গ্রহণ করেন তারা তিন ভাই। তার পরবর্তি সময়েও তারা একে অপরের সঙ্গেই থেকেছেন দৃঢ়ভাবে।
উপেন্দ্রকিশোর ছিলেন অত্যন্ত আধুনিক ভাবনা চিন্তার অধিকারী।বাংলাদেশের ময়মনসিংহে তার পড়াশোনা চলত যে স্কুলে সেই স্কুলটিতে এককালীন বাংলার তৎকালীন গভর্নর জেনারেল গিয়েছিলেন পরিদর্শনে এবং সেখানে গিয়ে তিনি দেখেন একটি ছেলে আনমনে ছবি এঁকে যাচ্ছে, গভর্নর ছেলেটির কাছে গেলে দেখেন তার নিজের ছবি আঁকা হয়েছে। এই ঘটনাটি দেখে স্কুলের অন্যান্য ছাত্র-ছাত্রীরা তো বটেই সঙ্গে শিক্ষকরাও কিছুটা ভয় পেয়েছিলেন তবে শিশুটি এক্কেবারে ভয় পায়নি!
উত্তরে গভর্নর সেরকমভাবে সেই বাচ্চা শিশুটিকে কিছু বলেনওনি কেবল বলেছিলেন যে,
“তোমার এই প্রতিভাটিকে তুমি কোনদিন হারিয়ে যেতে দিওনা”
এবং শিশুটি সেই গভর্নরের কথা রেখেছেন। কোনদিনও সেই প্রতিভাটিকে আর হারিয়ে যেতে দেননি।
তিনি উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী।
১৮৭৯ সালে বৃত্তিসহ চলে আসেন কলকাতার প্রেসিডেন্সিতে পড়াশোনার খাতিরে এবং এখান থেকেই তিনি বিজ্ঞান বিষয় নিয়ে শেষ করেন তাঁর স্নাতকোত্তর এর পড়াশোনা। প্রেসিডেন্সিতেই তিনি তাঁর সহপাঠী হিসেবে পান আশুতোষ মুখোপাধ্যায়কে। বিজ্ঞান বিষয়ে তিনি তার স্নাতকোত্তর করলেও তার সাহিত্যের প্রতি টান ছিল খুব বেশি এবং তিনি ছবি আঁকা, গান করা ইত্যাদির প্রতি বেশি আসক্ত ছিলেন একপ্রকার। এমনকি তাকে দিয়ে গানও করানো হতো অনুষ্ঠানে।বাড়ির সঙ্গে সম্পর্কে তার প্রথমদিকে ব্রাহ্মসমাজ কে নিয়ে কোনো প্রভাব সেরকম ভাবে না পড়লেও পরবর্তী ক্ষেত্রে ব্রাহ্মসমাজের প্রতিষ্ঠাতা ও সমাজ সেবক দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের জ্যেষ্ঠ কন্যা বিধুমুখী কে বিবাহ করলে পালিতপিতা হরিকিশোর রায়চৌধুরী তাকে ত্যাজ্য করেন এবং তার অমতে বিবাহ করার জন্য তাকে বহিষ্কারও করেন। সেইসময় বছর ২৩ এর উপেন্দ্রকিশোর তখন কলকাতার ১৩নং কর্ণওয়ালিস স্ট্রিটের ব্রাহ্মসমাজের মন্দিরের বিপরীতে লাহাদের বাড়ির দো-তলায় ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতে শুরু করেন।
কলকাতা থেকেই তিনি শেখেন বেহালা বাজানো । ভীষণ ভালো বেহালা বাজাতেন উপেন্দ্রকিশোর সেইসময় । কিশোর সুকুমার সহ তার অন্য সকল ভাই ও বোনেরা নাকি বাবার বেহালা বাজানোর শুর শুনেই ঘুমিয়ে পড়তেন। শুধুমাত্র তার সন্তান-সন্তানিরাই নয়, কলকাতার রায় বাড়ির সামনে নাকি উপেন্দ্রকিশোর রায়ের বেহালার শুর শুনতেই দরজার বাইরে ভিড় জমাতেন মানুষজন। বাঁশি বাজানোতেও তার সমান পারদর্শীকতা ছিল বলে জানা যায়। ভালোবাসতেন গান এবং সুরকার হিসাবেও তাঁর পরিচিতি ছিল অনেকখানি। বহু বহুল প্রচলিত ব্রাহ্ম সংগীত বের হয়েছিল তারই কলম ধরেই। গীত রচনার পাশাপাশি তিনি শুরু করেন সংগীত বিষয়ক লেখালেখি বিভিন্ন পত্রিকায়। তিনি ১৮৯৬ সালে একটি বই লিখতেন যার নাম ছিল “শিক্ষক ব্যাতিরেখে হারমোনিয়াম শিক্ষা”। তাছাড়াও তার “বেহালা শিক্ষা” নামক বইতে বেহালা বাজানোর শিক্ষা বিষয়ক আলোচনা করেছিলেন তিনি।
একেধারে লেখক চিত্রকর প্রকাশক শখের বেহালা বাদক জোতির্বিদ সুরকার এর সঙ্গে রঙিন ছবির শখও ছিল তার । “Photography Is Silent Music” অর্থাৎ “ফটোগ্রাফি এক নীরব সঙ্গীত”- এই দৃষ্টি ভঙ্গিকে নিয়ে শুরু করেন তিনি ফটোগ্রাফি। তবে তার প্রথম প্রেম শিশু সাহিত্য। তাই তাঁর থেকে শিশু সাহিত্যিক এর শিরোপাটা অন্য কেউ আর কেড়ে নিতে পারেনি!
প্রথম প্রেম কোনোদিনও আর যাই হোক,
কেও কেড়ে নিতে পারে নাকি?
ভারতের হাফটোন ব্লক এর জন্মদাতা ছিলেন তিনি । আগে কাঠের ব্লকে ছাপা হলে লেখাগুলো একটু ঝাপসা কিংবা অস্পষ্ট থেকে যেত কিন্তু এই হাফটোন ব্লক এর পর লেখায় তীক্ষ্ণতা এল এবং শুরু হলো এক নতুন প্রিন্টের যাত্রা। ১৮৯৫ সালে বাংলায় তার নামে প্রতিষ্ঠিত হয় একটি মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান, যার নাম ‘ইউ রায় অ্যান্ড সন্স’। শোনা যায় বিলেত থেকে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি আনা হয়েছিল যার মাধ্যমে তিনি তাঁর এই হাফটোন ব্লক এর পথপ্রদর্শন শুরু করেন। ১৯১০ সালে যোগীন্দ্রনাথ সরকার “সিটি বুক সোসাইটি”, থেকে ‘ছেলেদের রামায়ণ’ অর্থাৎ তার প্রথম সাহিত্য প্রকাশ করেন এবং এক্ষেত্রে শোনা যায় ছেলেদের রামায়ণের প্রুফ সংশোধনের দায়িত্ব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেই স্বয়ং নিয়েছিলেন। এরপর আসে ছোটদের মহাভারত যা কিনা ছোটদের মতো করে ছোটদের জন্য পরিবেশন করা হয়। তারপরে আসে ‘টুনটুনি’র কথা যার প্রকাশ হওয়া এক বিপুল খ্যাতি, সম্মান এবং জনপ্রিয়তায় তাকে মুড়ে ফেলে। ছোটদের কাছে অত্যন্ত প্রিয় একজন হয়ে যান উপেন্দ্রকিশোর । তিনি চলিত ভাষা কে এমন সুন্দর ভাবে ছোটদের সাহিত্যের কাছে পরিবেশন করতেন যা আর কাউকেই আগে করতে দেখা যায়নি । গুপী গাইন বাঘা বাইন এর ক্ষেত্রেও এটি দেখা যায় যে, সেই সময়ের ভাষাশৈলী আজও মনে এক প্রকার দাগ কেটে যায়। উপেন্দ্রকিশোর ছিলেন একমাত্র ভারতীয় যার গবেষণা মূলক লেখা, প্রবন্ধ তৎকালীন সময়ে লন্ডনে এক বিশেষ পত্রিকা, ‘পেনরোজ পিকটোরিয়াল অ্যানুয়াল’- এ প্রতিনিয়ত ছাপা হত। থাকত তার নিজের তোলা ছবিও।
১৯১৩ সাল ছিল বাংলা শিশু সাহিত্যের এক উজ্জ্বলতম এবং গর্বের বৎসর। শিশুসাহিত্যের মাত্রাকে এক বিরাট রূপ দেয় ‘সন্দেশ’ পত্রিকা। রঙিন ছবি, উজ্জ্বল গঠন, মুদ্রণে পরিপাটি প্রথম সংখ্যা থেকেই প্রভাব ফেলেছিল পাঠকদের মনে এবং ক্রমশ এই প্রত্রিকা পাঠকদের মনে প্রিয় হয়ে উঠছিল। সন্দেশ পত্রিকাটি এতটাই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে সেই সময় যে, অনেকে মনে করেন সন্দেশ পত্রিকাটিকে এখনও অতিক্রম করা যায়নি। এক্ষেত্রে বুদ্ধদেব বসু, তার আত্মজীবনীতে লেখেন, “আমার আসার দিগন্তে হরিণের মতো ছুটে আসতো মাসে মাসে সন্দেশ পত্রিকা”।
১৯১৪ সালে উপেন্দ্রকিশোর সুকিয়া স্ট্রিট থেকে সপরিবারে চলে আসেন ১০০ নম্বর গড়পার রোডে তাঁদের নিজস্ব বসত বাড়িতে। এই বাড়ির সামনের দিকে ছিল মুদ্রণ ব্যবস্থা এবং দক্ষিণ অংশে ছিল বসত বাটী। লেখা ও রেখার মাধ্যমে তিনি ক্রমশ চেষ্টা করে গেছেন যাতে সন্দেশ পত্রিকার মানের উন্নতি ঘটে এবং সেই সময় দাঁড়িয়ে উপেন্দ্রকিশোর মোট ৩২ টি সংখ্যা সম্পাদনা করেন সন্দেশ পত্রিকার। সন্দেশ পত্রিকার সাথে যুক্ত বাঙালির আবেগ ও ভালোবাসা।
এটি কেবলমাত্র একটি নিছক সংবাদপত্র নয় !!
মুদ্রণ শিল্পের এক অনন্য ধারক হিসেবে এই সন্দেশ পত্রিকাটির কোন তুলনাই হয় না।
১৯১৫ সালের ২০শে ডিসেম্বর মাত্র বাহান্ন বছর বয়সে গিরিডিতে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরি পরলোক গমন করেন। তবে তাঁর যা স্বপ্ন ছিল ‘সন্দেশ পত্রিকা’-টি কে ঘিরে তা সফল হয়েছিল। মৃত্যুর পর উপেন্দ্রকিশোর এর সন্দেশ পত্রিকাটির সম্পাদনা ও প্রকাশের দ্বায়িত্ব নেন তার কৃতী পুত্র সুকুমার রায়। উপেন্দ্রকিশোরের হাত ধরেই বাংলা শিশু সাহিত্যের এক স্পষ্ট অবয়ব গড়ে উঠেছিল এবং তাঁর সাথেই শুরু হয়েছিল বাংলা শিশুসাহিত্যের অমর যাত্রা।
যেখানে আজকের এই ব্যস্ততা ভরা সময়ের মাঝে ক্রমশ লুপ্ত হতে বসেছে শিশুদের শৈশব।