কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী লিখেছেন “সত্যজিৎ প্রমাণ করে ছেড়েছিলেন যে তিনি শুধুই এক শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রকার নন, সব বয়সের ছোটোদের পত্রিকায় (সন্দেশ) একজন শ্রেষ্ঠ সম্পাদকও বটে”।
যে বাংলা গ্রন্থচিত্রণ জগৎ এর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রামচন্দ্র রায়, রূপচাঁদ আচার্য, মাধব দাস, নৃত্যলাল দত্ত ও আরও অনেকে।সেই জগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র সত্যজিৎ।
তাঁর পিতা পিতামহ, দুজনেই বাংলা গ্রন্থচিত্রণে নিজেদের কীর্তি রেখে গিয়েছেন। তাঁদের সৃষ্টি অলঙ্করণকে এক অন্যমাত্রা যোগ করেছে।যেভাবে লাইন ড্রয়িং উপেন্দ্রকিশোর গ্রন্থ অলঙ্করণে প্রয়োগ করেছিলেন তা যুগান্তকারী। সুকুমারও সেই ধারা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। সত্যজিৎ সেই প্রসঙ্গে বলেছেন “নিছক কলাকৌশলে সুকুমার উপেন্দ্রকিশোরের সমকক্ষ ছিলেন না, কিন্তু এই অভাব তিনি পূরণ করেছিলেন দুটো দুর্লভ গুণের সাহায্যে,এক হলো তার অসাধারন পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ও আর এক হলো তার অফুরন্ত কল্পনা শক্তি।তাই সুকুমারের আঁকা বাস্তব বা কাল্পনিক কোনো প্রাণীরই অস্তিত্বে অবিশ্বাস জাগে না”।
১৯৫৫ তে পথের পাঁচালী নির্মাণ করে সত্যজিৎ যেমন চলচ্চিত্র জগতে নতুন এক অধ্যায় আরম্ভ করেছিলেন ঠিক তেমনই চল্লিশের গোড়ার দিকে তিনি গ্রন্থসজ্জা ও গ্রন্থচিত্রণকে এক অন্য মাত্রা প্রদান করেছিলেন। ১৯৪৩ সালে বিদেশী বিজ্ঞাপণী সংস্থা ডি জে কিমারের সঙ্গে যুক্ত হন। সেই প্রথম ও একমাত্র চাকরি তার জীবনের। নন্দলাল বসু ও বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের সার্থক উত্তরসূরী সত্যজিৎ।
তাঁর কাজে ভারতীয় শিল্প ঐতিহ্যের সাথে পাশ্চাত্য শিল্পকলার যে এক অভূতপূর্ব সমন্বয় ঘটেছিল। তা সত্যিই তাৎপর্যপূর্ণ। সেই পাশ্চাত্য রীতি ও ভারতীয় ধ্রুপদী সত্ত্বার সঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছিলেন সরস ঘরোয়া বাঙালীয়ানাকে। তাঁর শিল্পের মধ্যে যে আশ্চর্য সরলতা রয়েছে সেটা লক্ষ্যণীয়। সিগনেট প্রেস প্রকাশিত অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের “পরমপুরুষ শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ” -এর প্রচ্ছদে যে কোনো শিল্পী হয়তো শ্রীরামকৃষ্ণদেবের প্রেমময় দিব্যমুখ আঁকতেন কিন্তু সত্যজিৎ সেখানে লতার আল্পনায় আঁকলেন নামাবলী,বাংলার চিরন্তন ঐতিহ্যশালী ডিজাইন। কিন্তু এই সকলের মাঝে তিনি এমন কিছুই করেননি যা দেশজ শিল্পের সত্ত্বাকে কোনোভাবে আহত করতে পারে।তিনি ভারতের ধ্রুপদী ও লোকশিল্পকে সমান শ্রদ্ধা করতেন।শিল্পী হিসাবে কখনও একটা ধারায় নিজেকে অবদ্ধ করে রাখেননি।তাঁর কাজ সবসময়ই ভীষণ বৈচিত্র্যময় ও গতিশীল।গ্রন্থচিত্রণে ক্যালিগ্রাফীর যথার্থ ব্যবহার ভারতে কখনো এভাবে দেখা যায়নি। এবিষয়ে সত্যজিৎ রায়ই পথিকৃৎ।নান্দনিকতা বজায় রাখা ছিল তার মূল।
দিলীপকুমার গুপ্ত যখন সিগনেট প্রেস প্রতিষ্ঠা করেন সেখানে সত্যজিৎ যোগ দেন শিল্পী হিসাবে। সত্যজিৎ রায় ও দিলীপকুমার গুপ্ত এই দুইয়ের যোগাযোগ বাংলা প্রকাশনার ক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী ঘটনা।যা বাংলা প্রকাশনাকে এক অন্য মাত্রা দিয়েছিল।সিগনেটের রাজকাহিনী, ক্ষীরের পুতুল,বনলতা সেন,রূপসী বাংলা ও আরও অনেক ঐতিহাসিক সব সংস্করণের প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণ করে গেছেন সত্যজিৎ।এই সিগনেট প্রেস যখন বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালী’র শিশু সংস্করণ ‘আম আঁটির ভেপু’ প্রকাশ করে সেই অলঙ্করণও করেন সত্যজিৎ। এই ঘটনাই তাঁর ‘পথের পাঁচালী’ চলচ্চিত্রের পূর্বস্বরূপ। নব পর্যায় যখন সত্যজিৎ রায় ‘সন্দেশ পত্রিকা’ শুরু করেন, ৬০ এর দশকে সেই সমস্ত প্রচ্ছদ নিজের হাতে তৈরী করতেন। এছাড়া ‘এক্ষণ’ পত্রিকা ও অন্যান্য বহু পত্রিকার কাজ সত্যজিৎ রায় করে গেছেন।তাঁর সাহিত্য কীর্তির বিস্ময়কর জনপ্রিয়তার পিছনে তাঁর সেই সরল ও নান্দনিক অলঙ্করণের ভূমিকাও কম নয়।তাঁর অমর সৃষ্টি ফেলুদা যে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা লাভ করেছে তার জন্য এই অলঙ্করণও দায়ী। পাঠক শুধু কল্পনাই নয়,বাস্তবে সেই সমস্ত চরিত্রকে দেখে নিজের মনে বসিয়ে নিতে পারেন।সত্যজিৎ-র করা গ্রাফিক ডিজাইন একটা আস্ত গবেষণার বিষয় হতে পারে। তিনি নিজের সিনেমার জন্যও প্রচুর কাজ করে গেছেন।পরিচালনার পাশাপাশি এটাই ছিল তাঁর সব থেকে বড় কীর্তি।প্রতিটি ছবির বিজ্ঞাপণ,পোস্টার সত্যিই আকর্ষণীয়।কিন্ত এই মানুষটির গ্রন্থচিত্রণের অবদান এখন প্রায়ই বিস্তৃত।
(ক্রমশঃ)