সালটা ছিল ১৯৫২ এর পয়লা ডিসেম্বর। যুক্তরাষ্ট্রের ডেইলি নিউজ পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়া একটি খবর পুরো বিশ্বে সাড়া ফেলে দিয়েছিল। শিরোনামে লেখা ছিল “Ex- GI becomes blonde beauty” অর্থাৎ , “প্রাক্তন এক সৈন্য রূপান্তরিত হলো ব্লন্ড বিউটিতে”।হ্যাঁ এটাই ছিল বিশ্বের প্রথম সফল লিঙ্গ পরিবর্তন। জর্জের ক্রিস্টিন হওয়ার ইতিহাস।
জর্জ জোর্গেনসন ছিলেন একজন অভিজ্ঞ আমেরিকান সৈন্য এবং নিউ ইয়র্ক, ব্রঙ্কসের বাসিন্দা। ছোটবেলায় জর্জে অন্যান্য ছোট ছেলেদের থেকে খুব আলাদা বোধ করতেন ।তরুণ বয়সেই জর্জ বুঝতে পেরেছিল যে সে একটি ভুল শরীরে আটকা পড়ে গেছে। সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার সময়ও জর্জকে পড়তে হয়েছিল অনেক সমস্যার মুখে। তার সঙ্গে থাকা দীর্ঘদেহী পুরুষ সৈন্য ছিল তাকে পুরুষ বলে মনে করতো না এবং জর্জ কে ভয় দেখাতো।
অপারেশনের দু মাস পর ডেনমার্কে ফিরে পুরো বিশ্ব কে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল ক্রিস্টিন। সেদিনও পত্রিকায় একটি ছবি প্রকাশিত হয়েছিল ।সেখানে দেখা যাচ্ছিল, একজন রোগ ছিপছিপে ২৭ বছর বয়সী ব্লন্ড নারী পশমের তৈরি মোটা কোট পরে নিউ ইয়র্কের এয়ারপোর্টে বিমান থেকে নেমে আসছেন।
১৯৮০-এর দশকে ক্রিস্টিন জর্জেনসেনকে নিয়ে একটি চলচ্চিত্র তৈরি করার সময় ডেনমার্কের একজন ডাক্তার এবং তথ্যচিত্র নির্মাতা টাইট রুটস আওয়ার বলেন, “জর্জের সেই সময়ের ছবিতে তাকে একজন সমকামী পুরুষের মতো দেখাতো। এবং এই কারণে জর্জকে সেনাবাহিনীতে অনেক সমস্যার মুখে পড়তে হয়েছিল”।
১৯৪০-এর দশকের শেষের দিকে জর্জ একজন ড্যানিশ ডাক্তার ক্রিশ্চিয়ান হ্যামবার্গার সম্পর্কে একটি নিবন্ধ এর সম্মুখীন হন, যিনি প্রাণীদের উপর হরমোন পরীক্ষা করে লিঙ্গ থেরাপি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছিলেন। জর্জ আশা করতে শুরু করলেন যে ডক্টর হ্যামবার্গার তার সমস্যার সমাধান করতে পারবে এবং ১৯৫০ এ তিনি কোপেনহেগেনে যান ডক্টর দের সাথে কথা বলতে।
কিন্তুএকজন মহিলা হওয়ার প্রথম পদক্ষেপটি ছিল মহিলা হরমোনের একটি দীর্ঘ কোর্স।
হ্যামবুর্গার ছিলেন প্রথম চিকিৎসক যিনি ডায়াগনেস করেছিলেন জর্জ জোর্গেনসন কে একজন ট্রান্সসেক্সুয়ালে। হ্যামবুর্গার জর্জ কে উৎসাহিত করেছিলেন ,একজন নারীর পরিচয় গ্রহণ করতে এবং জনসমক্ষে একজন নারীর মত পোশাক পড়তে। হরমোন কার্যকর হতে শুরু করার সাথে সাথে,হ্যামবুর্গার জর্জ এর শরীরের পরিবর্তনগুলি লক্ষ্য করে।
কিন্তু ড্যানিশ আইন অনুযায়ী কারোর ক্যাস্ট্রেশন (খোজা) করে দেওয়া ছিল অবৈধ। কিন্তু জর্জ এর মনোচিকিৎসক ইয়র্গ স্টিরুপ তাকে পরীক্ষা করে বলেন যে তিনি শারীরিক ও মানসিক দিক থেকে অপারেশন এর জন্য পুরো ফিট। এবং স্টিরুপ আইন পরিবর্তনের জন্য ডেনমার্ক সরকারের কাছে অপারেশনের উদ্দেশে ক্যাস্ট্রেশনের অনুমতি দেওয়ার জন্য আবেদন করেছিলেন। এই অনুমতির কারণেই অপারেশনের মাধ্যমে ক্রিস্টিন জোর্গেনসনের লিঙ্গ পরিবর্তনের কাজটাও সম্ভব হয়েছিল।
লিঙ্গ পরিবর্তনের প্রথম অপারেশন হয়েছিল জার্মানির বার্লিন শহরে ১৯৩০ এ লিলি এলবা নামক এক ব্যাক্তির শরীরে।কিন্তু সার্জারি সফল হয়নি এবং লিলি তার শেষ অপারেশন এর সময় মারা যান। কিন্তু এই এক্সপেরিমেন্ট জোর্গেনসনের ডাক্তারদের কিছু দিক-নির্দেশনা দিয়েছিল।
হরমোন থেরপির প্রায় এক বছর পর অবশেষে জর্জ অপারেশনের আসল পর্যায়ে যায় যেখানে তার জেনিটাল অঙ্গ কে পরিবর্তন করে পুরুষ থেকে একজন মহিলায় রূপান্তরিত করা হবে। “যদিও অপারেশন এ কি হয়েছিল টা অস্পষ্ট ।কিন্তু ক্রিস্টিন ও তার ডক্টর মনে করেন তার অপারেশন সফল হয়েছিল এবং এই অপারেশনের পর তার শরীরে যে কোন ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি তাতে আমরা সত্যিই বিস্মিত হয়েছি ” বলেন টাইট রুটস আওয়ার। এইবার শুধু আরেকটি পদক্ষেপ তার রয়ে গেছিল বাকি একজন মহিলা হয়ে উঠতে তা হলো তার নাম। এই বার জর্জ তার নাম পরিবর্তন করে রেখেছিল ক্রিস্টিন।
অপারেশনের পর ক্রিস্টিন তার বাবা মাকে দেওয়া চিঠিতে লিখেছিলেন “প্রকৃতি একটা ভুল করেছে যা আমি সংশোধন করেছি, এবং এখন আমি তোমাদের মেয়ে।”তার পরিবার তার সিদ্ধান্তকে সমর্থন করে তাকে গ্রহণ করে নিয়েছিল।
এবং ক্রিস্টিনের অপারেশন সফল হওয়ার পর আমেরিকা থেকে অনেক নারী হ্যামবুর্গারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। তারাও তাদের লিঙ্গ পরিবর্তনের ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন।
১৯৬০ এবং ৭০ এর দশকে তিনি একটি আরামদায়ক জীবনযাপন করেন । দুবার সম্পর্কে জড়ালেও ক্রিস্টিন জোর্গেনসন কখনো বিয়ে করেনি। তাকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হলে সে সবসময় বলেছে “আমি আমার জন্য প্রকৃত মানুষ খুঁজে পাইনি”।
যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যাওয়ার পর ক্রিস্টিন ক্যালিফোর্নিয়ায় বসবাস করতে শুরু করেন এবং হয়ে ওঠেন হলিউড সেলেব্রিটি। দেশে ফিরে আসার পর ক্রিস্টিনকে “উইমেন অফ দ্য ইয়ার” মর্যাদাপূর্ণ সম্মানে ভূষিত করা হয়েছিল ।
তিনি নিজেকে নিয়ে একটি আত্মজীবনী ও লেখেন যার নাম ছিল “দ্য স্টোরি অফ মাই লাইফ”। ১৯৮৯ সালে ক্রিস্টিন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। মারা যাওয়ার কিছু বছর আগে ক্রিস্টিন তার ডাক্তারদের সাথে আবার দেখা করতে যায় ,যারা তাকে একটি নতুন জীবন দান করেছিলেন।
১৯৫০ এর দশকে ডেনমার্কে রক্ষণশীল সংস্কৃতি সত্ত্বেও ক্রিস্টিনের এই পদক্ষেপ অনেক মানুষকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল এবং আজও যুগিয়ে চলেছে।
লেখক পরিচিতি : দিশাসাহা
বিদ্যাসাগরকলেজেরছাত্রী
বিষয় : জার্নালিসম্ওমাসকমিউনিকেশন