নয়া গ্রামের মেয়েদের হাতে গড়ে তোলা ‘যো’ নামের ষষ্ঠী পুতুল,যা লোকশিল্পের এক অদ্ভুত নিদর্শন।
পশ্চিম মেদিনীপুরের নয়া গ্রামের পটুয়া বসতির ‘পটচিত্র গীতি’ , এহেন এক অন্য বাংলার চিত্র তুলে ধরে আমাদের কাছে। মাত্র কয়েকটি পরিবার মিলেই সেই পটুয়া বসতি। যেখানের মহিলারা কেবল ঘর গৃহস্থালির কাজে থেমে থাকেননা। নিজেদের চিত্রকলার পারদর্শিতায় তুলে ধরেন শক্তিশালী সামাজিক কিংবা রাজনৈতিক বার্তা গুলিকেও। যা পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তে বাংলার চিত্র শিল্পের ভীত গাঁথতে বাধ্য একপ্রকার। এমনকি পট আঁকার অবসরে তারা আরেকটি শিল্পের সাথেও নিজেদের বেঁধে রাখেন, কী সেই শিল্প? জানেন না, তাই তো ?
এ হলো পুতুল শিল্প। যতটা সুন্দর সেই শিল্প, তার চেয়ে অধিক সুন্দর সেই পুতুলের নাম। ‘যো’নামের ষষ্ঠী পুতুল।


মনের সমস্ত আবেগ ও আকাঙ্খা মিলিয়ে মিশিয়ে হাতের আঙুলের সাহায্য নিয়ে একপ্রকার টিপে টিপে বেলেমাটিকে বুঝিয়ে সুজিয়ে নিজের মতো করে তৈরি করেন তাঁরা তাদের ‘যো’ পুতুল। পুতুলের আকার এবং বিষয় বিশেষ মোন ছোঁয়া। ছোট্ট পুতুল গুলো, বলে দেয় তারা কখনো মায়ের স্নেহের মোড়া কোলে চুপটি করে শুয়ে , আবার কখনো মা তার সন্তানকে তেল মাখাচ্ছেন, মা ও শিশুর এমন মিষ্টি সম্পর্ক বেশ মন ছোঁয়াতো বটেই সাথে হাতি, ঘোড়া, পাখি, কুকুর, বেড়াল ছানা সব মিলিয়ে এহেন বাংলার মাটির সম্পূর্ণ মিষ্ঠতা মিশিয়ে তৈরি হওয়া এক নিদর্শন। আধুনিকতার এক ছিটেফোঁটাও এই শিল্পে পাওয়া দুষ্কর।
ভরা সংসারের খুশির বার্তা বহনকারী এই পুতুল গুলি আদপে ষষ্ঠী পুতুল। গৃহস্থের খোকা হোক বা বউ তাদের কোলে-কাঁধে পো থাকুক এমন ইচ্ছের চাহিদাতেই এই পুতুল তৈরি করা হয়। গ্রাম বাংলার লোকচিত্রের এক অপূর্ব নিদর্শন এই পুতুল। পুতুলের সামগ্রিক চরিত্র হলো সরল। একেবারে সিম্পল এবং সাজেষ্টিভ তার রূপ। পুতুল তৈরির কাজ শেষ হলে মাটিকে পুড়িয়ে গড়ন পোক্ত করা হয়। গড়ন শেষে হাতের কাছে পটের রং থাকলে দু-চার ফোঁটা রং লাগানোর রেওয়াজ খানাও একেবারেই মন্দ নয়।
তরুণ প্রজন্মের এক মেয়ে রেজিনা, তার বলা বিশেষ এক সংবাদ মাধ্যমে জানান “মেলা পার্বণে এই পুতুলের দর ও কদর দুই আছে” রেজিনা তার এই পুতুল বানানোর শিক্ষা পান তাঁর মা আয়েসা চিত্রকরের কাছে থেকে। ইসলাম রেজিনাদের জীবনধর্ম হলেও, মায়ের স্নেহের তো আর কোনো ধর্ম বিশেষ হয় না। মায়ের স্নেহ ও ভালোবাসা প্রকাশের এক অন্য রূপ বলা যেতেই পারে এই ‘ষষ্ঠী পুতুল’ বা ‘যো’ পুতুল গুলিকে।
ইতিহাস অবশ্য অন্য কথা বলে, পুতুল বিশেষজ্ঞদের মতে অবশ্য মিশরীয় কিংবা সিন্ধু সভ্যতা অথবা মেসোপটেমিয়া সভ্যতায় পাওয়া পোড়ামাটির বেশ কিছু পুতুলের নিদর্শন সাথে এর চারিত্রিক গঠন বেশ সমতুল্য। আলপোনার ‘কোলেপোকাঁধেপো’ ছবির সাথেও এর চেহারার সাদৃশ্যতা রয়েছে। তবে পশ্চিম মেদিনীপুরের নয়া গ্রামের সাথে সিন্ধু কিংবা মিশরের সভ্যতার সাথে কি সম্পর্ক সে বিষয়ে তারা ভাবনা চিন্তা করেন না। তারা কেবল ব্যাস্ত নিজেদের চিত্রকলা প্রদর্শনী কে ঘিরে, তাদের নিজস্ব হাতের কাজকে ঘিরে। নয়া গ্রামের পোটো পল্লীতে মেয়েরাই এই শিল্পের জনক। আরও নানান ভাবনায় তারা মগ্ন।
এক ঘোড়ায় চড়া টুপি মাথায় এক পুরুষ, রেজিনা বলেন,“উনি আমাদের নেতা সুভাষচন্দ্র”।
সব মিলিয়ে বলা যায় যে, পটুয়া শিল্পীরা যেভাবে পটচিত্রের মাধ্যমে অথবা পটচিত্র গীতির মাধ্যমে যেভাবে লোকচিত্রের এই প্রাচীন ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রেখেছেন , ঠিক তেমনই রেজিনারা টিকিয়ে রেখেছেন এই মিষ্টি অজানা লোকশিল্পের রূপ ‘যো’ পুতুলটিকেও। ছোট্ট পুতুলগুলির ওজন খুব বেশি করা হয় না। বেশি ভারী ওজন করা হলে ঝুড়ি মাথায় নিয়ে মেলায় যাওয়া বেশ কঠিন। সেক্ষেত্রেই হালকা পুতুলেরই রেওয়াজ। মেদিনীপুর জেলার নাড়া জোল, বীরভূমের সিউরি, নির্ভয়পুর, হাওড়া জেলার চন্ডীপুরেও এই পুতুলের সন্ধান পাওয়া যায়।
রেজিনার পুতুল কেবল মেলাতেই নয়, গ্রামে ছেলে ভোলানোর ক্ষেত্রেও এই পুতুল মায়েরা তুলে দেন তাদের সন্তানদের হাতে। মায়েরা এসে বলেন “ও রেজিনা, দুটো পুতুল দিয়ে যা তো”।
লেখক পরিচিতি :
সানি বাগ
জন্ম ৩রা জুন, ২০২০
বিধাননগর , উত্তর ২৪ পরগনা জেলার অধিবাসী।
বর্তমানে শেঠ আনন্দরাম জয়পুরিয়া কলেজের স্নাতক স্তরের সাংবাদিকতা ও গণজ্ঞাপণ বিষয়ের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র । এছাড়াও এক ছোটো সংবাদ পোর্টালের ইন্টার্ন।