নির্দেশনা : অনির্বাণ ভট্টাচার্য্য
ওয়েব সিরিজ – রিভিউ
সোমনাথ ঘোষ
বহমান এই কালস্রোত , যা অক্লান্তভাবে ছুটে চলেছে চলন্ত ট্রেনের সাথে পাল্লা দিতে থাকা চাঁদটার মত । এই ‘ কাল ‘ এর হিসেব কষে চলা ভীষণ জরুরী । নয়তো জীবনের এই যাত্রায় ঘুমালেই নিকষ মৃত্যু ! তাই তো , ” ম্যাকবেথ শ্যাল স্লিপ নো মোর ” ! আর এই ‘কাল’ কেই শেক্সপিয়ারের কালজয়ী নাটক ‘ম্যাকবেথ ‘ এর উপর নির্ভর করে চৌকো পর্দায় ধরতে চেয়েছেন অনির্বাণ ভট্ট্যাচার্য তাঁর প্রথম ওয়েব সিরিজ ‘মন্দার’ এ , সমুদ্রতীরবর্তী গেইলপুর নামের এক জায়গার প্রেক্ষাপটে ।
পাঁচ এপিসোডের এই সিরিজের সূত্রধর মজনু বুড়ি ও পেঁদো নামক দুই চরিত্র যারা সহজেই ডাইনিদের মনে করায় । তাঁদের মাধ্যমেই পরিচয় ঘটে কেন্দ্রীয় চরিত্র মন্দারের , একে একে আসে লাইলি , বন্কা , ডাব্লু ভাই , মদন হালদার , মণ্চা , মুকাদ্দর মুখার্জীরা । ম্যাকবেথকে অনুসরণ করেই সিরিজটি হলো ক্ষমতা এবং প্রতিশোধের গল্প আর এই গল্প হলো সময়ের । তাই মজনু বুড়ির ভাষ্যে কালের হিসেব উঠে আসে বারবার । সিরিজ জুড়ে মজনু বুড়িকেই কালের প্রতিভূ মনেহয় কখনও কখনও । তবে ক্ষমতার সাথে আসে লোভ । সেই লোভের জন্য লাইলির হাতিয়ার অবাধ যৌনতা আর কয়েনের উল্টোপিঠে মুকাদ্দার মুখার্জীর যৌনতার লোভেই ক্ষমতার ব্যবহার কোথাও গিয়ে এক হয়ে যায় । তবে লাইলির যৌনতা এখানে যেন উদ্দেশ্যপ্রণীত । ধ্বজভঙ্গ মন্দার সন্তান চায় ভবিষ্যতের কথা ভেবে , ক্ষমতা কায়েমের কথা ভেবে , যদিও গদির লোভকে চাপা দিতে পারে না বিবেক , তাই তো কাপড়ে রক্তের দাগ ভুলতে পারে না । আবার মন্দার চরিত্রটি রক্তের স্বাদ পাওয়া বাঘের মত । পরে চিরাচরিত শাসকের মতই ক্ষমতা দখল করে লাইলিকে ব্যবহার করতেও পিছপা হয়না । মন্দার, লাইলি , ডাব্লু ভাই , মুকাদ্দার সবার কাছেই সিংহাসন আয়ত্বে আনা মুখ্য হয়ে ওঠে , এক হয়ে যায় fare is foul and foul is fare । যদিও সিরিজে তার অনুবাদ ‘ কপাল ইজ পোঁদ , পোঁদ ইজ কপাল ‘ কোথাও যেন লঘু করে দেয় । ক্ষমতার লোভ বন্কারও রয়েছে তবে অভাব সাহসের , আর রয়েছে পিতৃস্নেহের পিছুটান । তাই নিজের পাপের দায় যাতে সন্তানের ওপর না বর্তায় সেই ভয় থাকে । আর রয়েছে মুকাদ্দার মুখার্জী । ক্ষমতার চেয়েও নারীতে আসক্তি হয়তো তাকে ক্ষমতার ইঁদুর দৌড়ে রাখেনি কিন্তু মন্দারের ভাগ্যনির্ধারণে তাঁর ভূমিকা দর্শককে তৃতীয় ডাইনির কথা মনে পড়ায় । সিরিজের পর্বগুলো নামকরণের সাথে যুক্ত তবে দর্শকের সুবিধার্থে কিছু ঘটনার পূর্ব প্রেক্ষাপট থাকলে হয়তো সুবিধা হতো । বিশেষত লকার চরিত্রটা যেভাবে শুরু হয়েই শেষ হয় সেটা দর্শক মনে অপূর্ণতা তৈরী করতে পারে । এই সিরিজের গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো মুহূর্তসৃষ্টি । ছবির শুরুতেই গাড়িতে করে মাছ নিয়ে যাবার দৃশ্যে সামাজিক স্তরভেদকে দেখানো , বন্কার ভাষ্যে লকার সাইকেলের চাবিতে ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ দেখে ‘ এটা কোন কিলাব রে ? ‘ বিপ্লবকে প্রাতিষ্ঠানিক করে দেয় এক মুহূর্তে । সিরিজের প্রথম চারটি এপিসোড বেশ টানটান ,তবে রান কম পড়লো স্লগ ওভারে গিয়ে । ম্যাকবেথ নির্ভর সিনেমায় প্রতিশোধ একটা বড় বিষয় , হয়তো আরো ছড়িয়ে খেলার জায়গাও ছিল কিন্তু কোথাও যেন সিরিজটা হঠাৎ করেই শেষ হয় । শেষটা যুক্তিহীন নয় তবে নাটকীয়তার অভাব দর্শকের মনে কিছুটা অপ্রাপ্তি তৈরী করে । তবে একশ্রেনীর দর্শক যারা ম্যাকবেথ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল তাঁদের মনে হয়তো সিরিজটি অনেক প্রশ্ন তৈরী করবে । বরং একটি সাধারন সিরিজ হিসাবে দেখতে বসা দর্শকদের হয়তো বেশী টানবে ‘ মন্দার ‘ !
সিরিজের অভিনয়ের দিক দিয়ে প্রায় সবাই যথাযত । কেন্দ্রীয় চরিত্রে দেবাশীষ মণ্ডল (মন্দার) যৌন অক্ষমতা থেকে হতাশা , নিজের ভবিষ্যৎ জানতে চাওয়া এবং গদি বাঁচানোর তীব্র ইচ্ছার অভিনয় ফুটিয়ে তুলেছেন পোক্ত অভিনেতার মতই , সোহিনী সরকারও নজর কেড়েছেন দর্শকের। শঙ্কর দেবনাথ (বন্কা ) , দেবেশ রায়চৌধুরী (ডাব্লু ভাই ) অভিজ্ঞ অভিনেতা , পরিসরমাফিক কাজ করেছেন ভালোভাবে । অনবদ্য অভিনয় করেছেন লোকনাথ দে (মদন হালদার ) এবং সজল মণ্ডল (মজনু বুড়ি )। নতুনদের মধ্যে দিগন্ত সাহা (মন্চা ) কোরক সামন্ত(ফাণ্টুস) লকুমনি (দোয়েল রায় নন্দী ) তাঁদের ভূমিকায় যথাযথ । আর রয়েছেন অনির্বাণ ভট্ট্যাচার্য (মুকাদ্দার মুখার্জী ), নিজের প্রথম পরিচালনাতেই নিজের গলার ধাঁচ ভেঙ্গে অন্য ধারার অভিনয় বেশ চ্যালেঞ্জিং , আর তিনি কাজটা করেছেন সফলভাবেই । চরিত্রটি কোন দর্শকের পছন্দ হতে পারে , কোন দর্শকের অপছন্দ হতে পারে কিন্তু চরিত্রটিকে এড়িয়ে যাওয়া প্রায় অসম্ভব ।
এই সিরিজের সম্পদ হলো ক্যামেরা, মেক আপ ও ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক । শুরু থেকে শেষ অবধি অসাধারণ কিছু ক্যামেরা আর ড্রোনের কাজ উপহার দেয় এই সিরিজ । তা সেই প্রথম দৃশ্যে মাছের গাড়ি যাওয়া হোক অথবা মন্দারের দৌড় । রয়েছেন মেক আপ আর্টিস্ট সোমনাথ কুন্ডু । আমাদের দেশে এই শ্রেনীর লোকের কাজ অন্তরালে থেকে যায়, সজল হালদারকে মজনু বুড়ি করে তোলার জন্য মেক আপ আর্টিস্ট ও তাঁর টিমের জন্য আলাদা হাততালি বরাদ্দ রাখতেই হয় । আর রয়েছে ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর , যা দর্শককে সিরিজের সাথে রিলেট করতে বাধ্য । সব মিলিয়ে প্রথম পরিচালনায় কিছু খামতি ছাড়া দর্শকের কাছে হয়তো অনির্বাণ ভট্ট্যাচার্য পাশমার্কের চেয়ে বেশি কিছু নম্বর ব্যাগে নিয়ে দর্শকদের এক উপভোগ্য সিরিজ উপহার দিতে পেরেছেন ।
লেখক পরিচিতি : সোমনাথ ঘোষ
( পেশায় শিক্ষক ও লেখক )
স্থান : বেলুড়