রান্নাঘরের জানলাটা খুলতেই রোজকার মত পরিচিত গন্ধগুলোতে মন ভালো হয়ে যায় আসিফার। এ পাড়াতে বাড়িগুলো পাশাপাশি, খাবারের বাটি আর গন্ধ চালাচালি হতে প্রায় একই সময় নেয়। নামে দাসপাড়া হলেও তারা আর মুক্তাররা পুরোনো বাসিন্দা হওয়াতে বাকিদের সাথে খুব দহরম-মহরম না থাকলেও মৌখিক সদ্ভাবটুকু রয়েছে । পাশের মুক্তারদের বাড়ির রসুন বাটার গন্ধ , দত্তদের বাড়ির শুক্তোর, নীচের কালির কারখানার গন্ধগুলো বহুবছরের অভ্যাসে বা ভালোলাগায় কবে জুড়ে গেছে মনে করতে পারেনা। মায়ের কথা মনে পড়ে আসিফার। “আম্মু, আমাগো মাইয়াগো বেবাক মানাইতে হয়,আর তাতে ওইভ্যাসও হইয়া যায়। ”, মানিয়েই নিয়েছে বটে আসিফা, আর না মানার সামর্থও ছিল কি? উত্তরটা ভালোভাবেই জানা তার। নতুন জায়গা,বাঙাল টান ছাড়া কথা অভ্যেসেও ঢুকে গেছে। আর আটাশ ঊনত্রিশ বছরে অনেক স্মৃতিই চাপা পড়ে যায়। তবে সন্ধ্যেবেলা যখন অন্তুদের বাড়ি থেকে শাঁখের আওয়াজ ভেসে আসে তখন পায়রাডাঙ্গার কথা মনে পড়ে আসিফার । সেখানে মুসলিমপ্রধান এলাকায় কয়েকঘর হিন্দু বাড়ি থেকে আসা শাঁখের আওয়াজ মনে থাকা জিনিসগুলোর মধ্যে অন্যতম। আবছা আবছা মনে আসে ইসমাইল চাচার গুমটি, শুকদেবের চায়ের দোকান , হারানদের মাদ্রাসা, জোড়মন্দিরের পেছন। গত কদিন ধরে স্বপ্নটা আবার দেখছে, তাই হয়তো মনে পড়ছেও বেশী। রথের মেলা , জোড়া মন্দির, হলদে শাড়ী, রক্তর ছাপ….
কলিং বেলের শব্দে চিন্তার সুতোগুলো আচমকা ছিঁড়ে যায় আসিফার। শবনম এসেছে। ছেলেকে স্কুলে দেওয়ার পথে কখনো-সখনো মায়ের সাথে দেখা করতে আসে সে। দরজা খুলতেই একগাল হাসি নিয়মমাফিক ছড়িয়ে দেয় শবনম , “আয়” বলে ঘরে ঢুকে যায় আসিফা। শবনম ঢুকে হাতের ব্যাগটা নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকতে প্রশ্ন করে আসিফা “কী এনেছিস রে?”
-বলবো কেন? সারপ্রাইজ! আব্বা ভালোবাসে এমন একটা জিনিস আনলাম। রাতে টিফিন বক্স খুলে দেখ।
-ওহ। ফ্রিজে রাখ , তোর আব্বা আজ পাবদা মাছ এনে খেতে চেয়েছে । এটাও বরং দেব সাথে।
-ওহ । আব্বা কখন আসবে গো?
-আজ তো বললো রসুলকে নিয়ে কারখানা থেকে খিদিরপুর যাবে।
-আচ্ছা । রসুলদা কেমন আছে গো? দেখা হয়না অনেকদিন।
-ভালো।
-তোমার প্রেশার চেক করিয়েছ?
-হুঁ।
-কী বললো ডাক্তার ?
-ওই যেমন থাকে।
– ওষুধ খেতে ভুলছো না তো আবার?
– শরীর ঠিক রাখতে বাকি সবের সাথে ওটাও মনে রাখতে হয়।
-তোমার মনে না থাকলেও আব্বার
-তালেই হয়েছে।
-কী যে বলো না! আব্বা তোমার কত্ত খেয়াল রাখে!
– সে রাখে, খেয়াল তো অশোকবনে রাবণরাজাও সীতার খেয়াল রাখতো।
-ধুস! তুমি না ! না ভাবো আব্বার যদি দশটা মাথা থাকতো! হা হা!
– সব মুখ কী আর সব সময় দেখা যায়?
-কী যে বলো না মাঝেমধ্যে।
-জানো আজ জিশানদের স্কুলে কী হয়েছে?
-ধুর বাবা এত বকিস কেন!
মা কে হঠাৎ এরকম ঝাঁঝিয়ে উঠতে দেখে অবাকই হয় শবনম। কাছে গিয়ে বলে “কী গো শরীর খারাপ ?”
-না না ঠিক আছি। ও এমনিই।
কাছে এসে দাঁড়ায় শবনম। “কী এমনি? তোমার মুখচোখ দেখেই মনে হচ্ছে কিছু একটা হয়েছে। এসে থেকে দেখছি আনমনা , ছাড়া ছাড়া উত্তর দিচ্ছ ”।
-আরে না রে ঠিক আছি। আসলে তোর বিয়ের পর বাড়িটা ফাঁকা লাগে আরো । তাই কখনো মনখারাপ।
মায়ের কথা শুনে আবার চেয়ারে গিয়ে বসে শবনম, যদিও ছোটবেলা থেকে সে দেখেছে তার চিরকালের কম কথা বলা মা হঠাৎ কেমন নিস্তব্ধ হয়ে যায় কদিন ধরে, সেই সময়টা মেলানো যায় না কারণ এর সাথে যোগ হয় হঠাৎ রেগে যাওয়া । আবার এত কম সময়ের জন্য হয় যে কখনো চিন্তার বিষয় বলেও মনে হয়নি। আজকের মতোই আচমকা রেগে যায়। ছোটবেলা থেকে দেখত এই অবস্থায় আব্বার সামনে এলেই চুপ করে যেত মা, বড় হওয়ার পর ভাবতো হয়তো শ্রদ্ধায়। তবে এখন মাঝেমধ্যে মনেহয় হয়ত ভয়ে। এই জিনিসটা চিরকালই অদ্ভুত লাগে শবনমের।
শবনম চলে যাওয়ার পর আসিফা আড়ষ্ট হয়ে আসে। যদিও এরকম আগেও হয়েছে কিন্তু সামলেও নিয়েছে সে। লজ্জায়, ভয়ে কখনো বলতে পারেনি শবনমের আব্বাকে। বড় হওয়ার পর শবনমকেও বলতে পারেনি সে কিছু। সেই এক স্বপ্ন , এক মায়াময় মুখ, যদিও আবছা কিন্তু পরিচিত বলে বুঝতে অসুবিধা হয় না। সেই খদ্দরের পাঞ্জাবী আর তাতে ছোপ ছোপ রক্তর দাগ। তার একটা হাত নেই আর অন্য হাতে একটা একটা শাড়ী। আসিফার দিকে এগিয়ে আসতেই প্রতিবার স্বপ্নটা ভেঙ্গে যায়। আর কয়েকদিন ধরে কী যেন চলতে থাকে তাঁর মধ্যে। যে ভাবনাগুলো আসে অন্যসময় সেগুলো চিন্তা করলেও আঁতকে ওঠে আসিফা।
সন্ধ্যে নেমেছে দাসপাড়ায়, সাদাটে নিস্তব্ধতা ল্যাম্পপোষ্টের আলোয়। নিস্তব্ধতা ওই দুতলার ঘরটাতেও, তবে সেটা সাদা নয়। চিরায়ত মানবমনের মতো ধুসর। ঘরের এক কোণের টিভিতে সিরিয়ালের দিকে তাকিয়ে আছে আসিফা। সিরিয়ালে মুখ নেড়ে চলেছে কতগুলো চরিত্র , যদিও সংলাপ অন্য কারোর লেখা , ঠিক যেমন তাঁদের টিকিটা অন্য কোথাও বাঁধা, মনেহয় আসিফার। আশ্চর্য হয় মাঝেমধ্যে এই চিন্তাগুলো আসে কোথা থেকে! এই একটু আগেই পাশে অন্তুদের বাড়ির শাঁখ বাজানোর শব্দ শুনে মনে হচ্ছিল টিকিটা অন্য কারো হাতে না বাঁধা থাকলে সেও হয়তো শাঁখ বাজাতো আজ! তাঁর এই চিন্তার হদিশ অন্য ঘরে হিসাবের খাতা নিয়ে বসা শবনমের আব্বা পাবে না বলে আমোদিত হয় আসিফা। আসিফা যদিও জানে লোকটা মনের দপ্তরে আগ্রহী নয় । বরং সময়ের হিসাব কষা আর তার সুযোগ নেওয়ায় বিশ্বাসী। সেই বহুকাল আগে গ্রামের ঝামেলা থেকে পিঠ বাঁচিয়ে এসে কীভাবে এখানে ব্যবসা জমিয়েছে, বাকিদের হটিয়েছে তাই নিয়ে প্রচ্ছন্ন গর্ববোধ রয়েছে। আসিফার তখন গ্রামের দীপঙ্কর মাষ্টারের প্রায়ই বলা একটা কবিতার কটা লাইন মনে পড়ে আবছা , “রথ ভাবে আমি দেব পথ ভাবে আমি মূর্তি ভাবে আমি দেব হাসেন অন্তর্যামী ”!
“পালায়ে যান দাদা পালায়ে যান। আমরা আপনাগোর শুভাকাঙ্ক্ষী , কিন্তু হক্কলে তো তা লয়”। আব্বাকে পরিষ্কার এই কথা বলতে শুনেছিল দীপঙ্কর মাস্টারকে। মাস্টারমশাই যদি দরাজ গলায় বলেছিল “চিন্তা কোরো না মতিউর মিঞা। আমাকে মান্যিগন্যি করে গ্রাম প্রধানরা”। তবে আসিফার আব্বা বলেছিল “হাওয়া মন্দ মাস্টার, সাবধান হও গে”। আসিফার মনে কু ডেকেছিল অবশ্য আগেই। রাসের মেলার দিন লুকিয়ে বিপ্লবদার সাথে দেখা করতে গিয়েছিল জোড়ামন্দিরে। যতই গ্রামের নামী মাষ্টারের ছেলে হোক হিন্দু মুসলিম প্রেম যে মানার নয় এই বোধ বিপ্লবদার ছিল । কিন্ত বিপ্লবদা তার হাত ধরার সঙ্গে সঙ্গেই একটা শব্দে চমকে উঠেছিল দুজন। কখন না জানি গ্রামের আবদুর এসে দাঁড়িয়েছে, গ্রামের আড়তদারের ছেলে, পড়াশোনার পাট চুকিয়ে ব্যবসাতে ঢুকেছে। একটা হিমশীতল দৃষ্টি হেনেই হনহন করে হাঁটা দিল। এরপর পরিস্থিতি খারাপ হতে থাকলো। এখান ওখান থেকে ঝামেলার খবর আসতে থাকায় মহল্লা উত্তপ্ত হতে থাকলো। মাঝে গ্রামপ্রধানের লোক চুপিসারে এসে মতিউর মিঞাকে শাসিয়ে গেল মেয়ে যাতে বেজাতের সাথে না মেশে । তারপর হঠাৎ করে একদিন গ্রামের শুকদেব, আসীম,দীপঙ্কর মাস্টাররা পরিবার সমেত নেই হয়ে গেল। কদিন প্রবল জ্বরে ভোগার পর আসিফা ঘর থেকে বেড়োতেই মুখোমুখি হয়েছিল আবদুরের । আব্বা মুখ কাঁচুমাচু করে ঘরে ঢুকে যাওয়ার পর একটা দেঁতো হাসি হেসে আবদুর বলেছি “সবকটারে কিমা করসি জবাই কইরা, তোর নাগরকেও, যেভাবে কাটসি ওগুলো গোস্ত হইলে কিমা ভুনা ভালো হইতো !” তারপর পরপর ছবির মত রথের মেলা , জোড়মন্দির, আবছা মুখের বিপ্লবদা, রক্ত , কাটা হাত! যেন এইমাত্র হলো সবটা। বিছানায় ধড়মড়িয়ে উঠে বসলো আসিফা, গলা শুকিয়ে এসেছে, ব্লাউজ ভিজে জবজবে প্রায়। দেখলো পাশে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছেন শবনমের আব্বা।
পরদিন দুপুরে শবনমের আব্বাকে খেতে দিতে বসে আসিফর মনে পড়ে শবনম খাবার এনেছিল। ভাতের সাথে তাড়িয়ে তাড়িয়ে খায় লোকটা। মেয়ের তৈরী খাবার ফেলতে পারে না। হাতের আড় চেটে বলে ওঠে “রান্নার হাতটা মেয়ে তোমার চেয়েও জব্বর পাইসে” । মৃদু হেসে সাড় দেয় আসিফা আর শবনমের আব্বার তৃপ্তি করে খাওয়া দেখে শান্তি পায়।
বিকেলের সূর্যটা তখন অস্ত যাচ্ছে। আরেকটা প্রাণও তখন অস্ত গেছে। ঘরময় দাপাদাপির পর মুখে গ্যাঁজলা উঠে স্থির হয়ে গেছে । পড়ে আছে ভাতের থালা , ডালের বাটি, অন্য বাটিতে খুব প্রিয় কিমার তরকারীর বিন্দুমাত্র অবশিষ্ট ছিল না । হয়তো শেষের আগের মুহুর্তে ভীর করে এসেছিল শুকদেব, দীপঙ্কর মাস্টার , বিপ্লবরা তবে বুঝেছিল খাবারেই কিছু ছিল বুঝতে পেরেছিল আবদুর রহমান, শবনমের আব্বা। পাশের টেবিলে একটা চিঠি পড়েছিল, তাতে লেখা ছিল “পাপ কাউরে ছাড়েনা। ছাড়া উচিতও নয়। মাইয়াগো সব সইতে পারে বলে সে অপরাধ চাপা দেওয়াও যায় না। আজ তোর সুযোগ নিয়ে তোর একটা পাপ খণ্ডালাম শবনম, মাফ করিস পারলে মা। তোর জন্যই এতদিন হয়তো আল্লা সামলে রেখেছিল আমারে।একজন খুনীর লগে চিরকাল ঘর করার পাপও সইছিল না। এখন তুই নিজের বোঝার সমুত্থ হয়েছিস, আমারও পিছুটান নেই। ভালো থাকিস, ন্যায়ে থাকিস। হয়তো আমিও ন্যায় করলাম নি, আসলে ঠিক বেঠিক কবেই বা আমাদের হাতে রয়েছে তবে কইতেই পারিস এতদিন পরে ক্যান, আসলে কী জানিস মা নিয়তি প্রতিশোধ নেয় সবচেয় অসতর্ক কালেই! আমায় মাফ করিস মা আর আমার খোঁজর করিসনা ।
আসিফা বিবি”
লেখক পরিচিতি: সোমনাথ ঘোষ
(পেশায় শিক্ষক ও লেখক)