আজ পারমিতা কে প্রথম বারের জন্য দেখতে আসছে। মা মরা মেয়েটা সেরকম আদর পাইনি কখনোই। গায়ের রঙ চাঁপা হলেও দেখতে ভারী সুন্দর। কলেজের গ্র্যাজুয়েশনটা সে একপ্রকার বাবার বিরুদ্ধে গিয়েই করেছিল। শিক্ষিতা হয়েও কখনোই সে পায়নি সম্মান । তার নিজের বাবাও মেয়েকে দায়ী করতেন তার মায়ের মৃত্যুর জন্য । এখন সে বড় হয়েছে, বিয়ের উপযুক্ত হয়েছে।
বিয়ের বয়সী মেয়েকে আর কতদিন ঘাড়ে বসিয়ে রাখবেন পরমেশ্বর বাবু? মেয়ের বিয়ে কবে দেবেন ? বয়স তো অনেক হলো? কালো মেয়েকে বসিয়ে রেখেছেন কেন ?
মেয়ের কোনো খুঁত নেই তো ?
এই রকমই সব প্রশ্নের ভয়ে তিনি যত তাড়াতাড়ি মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিতে পারেন, ততই তাঁর পক্ষে মঙ্গল। আত্মীয়-স্বজন কিংবা পাড়ার ঘটক কাউকেই বাদ দেননি পাত্র খোঁজার জন্য। পাত্র পক্ষ আজ দেখতে আসছে পারমিতাকে। পারমিতা আজকের মেয়েদের মতো এত পরিপাটি হয়ে থাকতে পারে না। সামান্য কাজলের আঁকা চোখ গোটা মুখের সৌন্দর্য কে যেন আরও হাজার গুন বাড়িয়ে তুলেছে। কপালের একটা ছোট্ট টিপ তার মুখে কম মানায় না। ছোটো পিসি বললে সে তার স্যান্ডেল টা খুলে উঁচু স্যান্ডেলটা পরে বাসার ওপাশের ঘরে গেল। যেখানে পাত্র পক্ষ তাঁর জন্য অপেক্ষা করছে।
গিয়ে বসল পারমিতা পাত্র পক্ষের সামনে।
পাত্রের মা জিজ্ঞেস করলেন,
– তুমি বাড়ির কাজ, রান্না এগুলো কি পারো?
পারমিতা অবাক হল, “আমার নাম কি? আমার শিক্ষাগত যোগ্যতা, কি করতে পছন্দ করি এগুলো না জিজ্ঞাসা করেই রান্না করতে পারি কিনা বাড়ির কাজ করতে পারি কিনা?এগুলো প্রথমে জানা কি খুব প্রয়োজন?”
সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর বাবা বলে উঠলেন।
-হ্যাঁ পারে তো । প্রায় সবকিছুই পারে। কি হলো মা বলো ওনাদের কি কি পারো।
-মোটামুটি টুকিটাকি সবকিছুই পারি। তবে এখনও শিখছি । বাড়ির কাজ গুলোও মোটামুটি পারি।
-আচ্ছা মা একটু গান গেয়ে শোনাও।
বলে উঠলেন ছেলের মা। আসলে ওটা গান শোনার বাহানা নয়। ওটা ছিল মেয়ের সুরেলা কণ্ঠ আছে কিনা তার পরীক্ষা।
পারমিতা বলে উঠল,
-না কাকিমা আমি গান গাইতে পারিনা।
ছেলের মায়ের মুখে একটু বিষন্নতা লক্ষ করা যায়।
-মেয়ের না আছে কোনো গুন না আছে রূপ।
ছেলের বাবাকে ভদ্রমহিলা খুব আস্তে বললেন ঠিকই। কিন্তু পারমিতা পাশে বসায় সে সবটা শুনে ফেলে। ছুটে গিয়ে নিজেকে ঘরে বন্দি করে দেয় সে। এরকম কথা সে শুনতে অভ্যস্ত হলেও সে নিজেকে থামিয়ে রাখতে পারেনি। সবটা না জেনে তার বাবা এসে তার ছুটে বেরিয়ে আসার মতো এই আচরণের জন্য বকাঝকা করেন এবং পাত্র পক্ষের কাছে ক্ষমাও চান । সে তাঁর উঁচু স্যান্ডেল গুলো খুলে দেখে স্যান্ডেলের ঘষা লেগে রক্তাক্ত তার পা। ওষুধ লাগলেও ব্যথা কমতে অনেক দিন। কিন্তু পরের দিনই আসার কথা অন্য এক পাত্র পক্ষের । পাশের পারাতেই ছেলের বাড়ি। তবে তাদেরও মেয়ের গায়ের রঙে খুব একটা সন্তুষ্ট দেখা গেল না। এভাবে একের পর এক সম্বন্ধ আসলেও কারোরই পারমিতাকে পছন্দ হলো না। মেয়ে কি কি পারে ? মেয়ের বয়স কত? এগুলোর উত্তর দিতে দিতে আজ সে ক্লান্ত। একবার একটি ছেলে তার সাথে আলাদা কথা বলার অনুরোধ করলে, পারমিতা একটু অবাক হয়। ছেলেটি তাকে বলে,
-কিছু মনে করবেন না, আমি অন্য একজনকে
ভালোবাসি। এই বিয়েটা আমি করতে পারবো না।
পারমিতার একটুও রাগ হলো না। সে বলতে পারতো,
“তাহলে এভাবে দেখতে আসার মানেটা কী?”
কিন্তু সে কিচ্ছু বললো না। কেবল বললো বাড়িতে কথাটা জানান। নাহলে আর কতদিন ভয় পেয়ে এভাবে অন্য মেয়েদের দেখতে যাবেন।
পারমিতা একজন শিক্ষিত মেয়ে। এভাবে তার গায়ের রঙের ওপর তার যোগ্যতা প্রশ্নের মুখে পরতে পারে না। তার বাবার প্রতি তার সমস্ত আস্থা ক্রমশ কমতে থাকে।পরের দিন আবারও আসার কথা এক নতুন পাত্র পক্ষের।
পারমিতার শাড়িতে বেশ অসুবিধা হচ্ছে দেখে, অনিমেষ বললেন আপনার যদি অসুবিধা হয় তাহলে আপনি অন্য কিছু পরে আসতে পারেন। সেরকম কোনো নিয়ম নেই যে শাড়িতেই বসতে হবে। অনিমেষের মা ও বললেন যাও মা পাল্টে এসো। পিসি পারমিতা কে নিয়ে ঘরে গেলেও মন তার পাশের ঘরেই। এরকম ভাবে কোনো পাত্র পক্ষ তার সুবিধা অসুবিধা দেখেনি।
পাশের ঘর থেকে পারমিতার চা এর প্রশংসা সে শুনতে পায়। অনিমেষের বাবা বলছেন,
-যে ভালো চা করতে পারে, সে সব পারে।
শুনে পারমিতা হাসে। সে আবারও পাশের ঘরে গেলে, তার বাবা বলে অনিমেষ ছাদে গেছে ।যাও দুজনে গিয়ে একটু কথা বলো।
দুজনের মধ্যে এক অদ্ভূত নিস্তব্ধতা বিরাজমান, কে আগে কথা বলবে ঠিক করে উঠতে পারে না তারা।
অনিমেষ বাবুই প্রথম কথা বললেন।
-আচ্ছা আপনি এত সুন্দর চা করেন কি করে?
দুজনেই হাসে।
-ছেলে ভালো হলেও যৌতুকটা অনেক বেশি নয় বাবা ? তুমি কোথায় পাবে এত টাকা?
-সে আমার পোড়া কপাল। এরকম মেয়ে ঘরে বসে থাকলে তো মোটা যৌতুক দিতেই হবে। তুমি বিদেয় হলে আমি একটু বাঁচি।
পারমিতার চোখের জল তখন তার বাবার পায়ে টপ টপ করে গড়াচ্ছে।
-তুমি একটুও পছন্দ করো না বলো আমাকে ?
বেশ। তোমাকে আর আমার জন্য ভাবতে হবে না।
-তা কোথায় যাবে শুনি ? মেদিনীপুরের বাইরে গেছো কোনো দিনও? খালি বড়ো বড়ো কথা বলা। ভাত বসাও আমি আসছি। ব্যাঙ্কের দিকে যাই একটু। কিছু লোন-টোন পাওয়া যায় কিনা দেখি গিয়ে।
কেবল পরমেশ্বর বাবুই ঘর থেকে বেরোননি সেইদিন। মায়ের রেখে যাওয়া গলার একটি সোনার পাতলা চেন এবং তার নিজস্ব সঞ্চয়ের কিছু টাকা নিয়ে সে পাড়ি দেয় অচেনা শহরের পথে। স্টেশনের দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেনের দরজায় দাঁড়ানো লোকটিকে খালি সে জিজ্ঞেস করে,
-দাদা এটা কি কলকাতার গাড়ি?
-হ্যাঁ দিদি। এটা কলকাতার গাড়ি।
জানালার ধারের একটি সিটে বসা মাত্রই ট্রেনের ইঞ্জিনের বিদায় আওয়াজ বেজে উঠলো। চাকা গড়াতে শুরু করলো কলকাতার দিকে। শুরু হলো পারমিতার জীবনের এক নতুন যাত্রা। শুরু করলো সে তার জীবন সংগ্রামের কথা গুলো লেখা, তার সাধের ডায়েরিটিতে।
হঠাৎ ট্রেনের ইঞ্জিনের আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে যায় পারমিতার। আজ সে একজন বিরাট এনজিও তে কর্মরত মহিলা সদস্য। যারা মহিলাদের হয়ে নানান কাজ করে থাকেন। সাথে একজন লেখিকা। যে নিজের জীবনকে নিয়ে লেখা গল্পে পাঠকদের চোখে অশ্রু ঝরান। এবং যিনি আজ প্রমাণ করাতে পারেন,
নিজের শরীরের রঙে নিজের যোগ্যতা হারিয়ে যায় না।
সানি বাগ
সল্টলেক, উত্তর ২৪ পরগণা জেলা-এর
অধিবাসীজন্ম ৩রা জুন, ২০০১
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এর অন্তর্গত,
শেঠ আনন্দরাম জয়পুরিয়া কলেজ-এর
দ্বিতীয় বর্ষের সাংবাদিকতা বিষয়ের ছাত্র।