ঋতুপর্ণ ঘোষ— বাংলা চলচ্চিত্রের অন্ধকার যুগে নতুন আলোর সূচনা

Share This Post

সমসাময়িক কালে বাংলা ভাষার এক অন্যতম শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র নির্মাতা ঋতুপর্ণ ঘোষ।
২০১৩ সালের ৩০ মে, মাত্র ৪৯ বছর বয়সে কলকাতায় নিজের বাড়িতে ঘুমের মধ্যেই চিরতরে নিদ্রা যান। অনেকগুলো বছর অতিক্রান্ত হয়েছে তার অকালপ্রয়াণের। ১৯৮০ সালে মহানায়কের মৃত্যুর পর বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে শুরু হয়েছিলো এক অন্ধকার যুগ।টালিগঞ্জ সিনেমার ইন্ডাস্ট্রি সেইসময় হিন্দি ও দক্ষিণ ভারতীয় ছবির অনুকরণ তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত সংস্থান কিংবা স্পর্ধা, কোনোটাই তেমনভাবে ছিল না। এরকম সঙ্কটকালীন পরিস্থিতিতে, ১৯৯৪ সালে ‘উনিশে এপ্রিল’-এর মাধ্যমে সিনেমার জগতে পদার্পণ ঋতুপর্ণ ঘোষের।
ঋতুপর্ণ শিল্প ও বাণিজ্যিক সাফল্যের এক অদ্ভুত সংমিশ্রণ করেছিলেন। বিজ্ঞাপনী সংস্থা ‘রেসপন্স’-এ কাজের সুবাদে অর্জিত দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে, তিনি অনায়াসে সত্যজিৎ রায়ের বুদ্ধিদীপ্ত চলচ্চিত্রের সাথে এক করে দিয়েছিলেন স্বর্ণযুগের তপন সিনহা ও অজয় করদের মতো বলিষ্ঠ নির্মাতাদের অপেক্ষাকৃত সহজবোধ্য সিনেমার ধারাকে। তিনি বাঙালি দর্শককে আবার
সিনেমাহলে ফিরিয়ে আনতে পেরেছিলেন, নিজের শিল্পসত্তা দিয়ে ধরে রাখতে পেরেছিলেন দর্শককে।
তাকে নিয়ে জীবনীমূলক তথ্যচিত্র ‘বার্ড অভ ডাস্ক’ তৈরি করা, লেখক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা সঙ্গীতা দত্ত বলেন,”তার সিনেমা সমস্ত সীমারেখা পার করে গিয়েছিল।”
মধ্যবিত্ত শহর কলকাতার সম্পর্ক-কেন্দ্রিক সিনেমা, ধ্রুপদী ও সমসাময়িক সাহিত্যের রূপান্তর এসবের মধ্য দিয়ে তিনি বের করে আনতে চেয়েছিলেন বিকল্প যৌনতা এবং জেন্ডার ইস্যুগুলোকে। এছাড়াও তিনি এমন একজন ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতা যিনি তার ছবিতে চলচ্চিত্র নির্মাণ কিংবা পারফর্মিং আর্টের বিষয়গুলো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তুলে ধরতেন। ঋতুপর্ণ রবি ঠাকুরের কাজগুলোর যে রূপান্তর করেছেন, তা সত্যজিৎ রায়ের রূপান্তরগুলোর থেকে অনেকটাই আলাদা। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যেমন চোখের বালি। মৃতপ্রায় বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির জন্য এক নবদুয়ার উন্মোচনের চেষ্টা করেছেন, ঐশ্বরিয়া রাইকে কোলকাতায় এনে অভিনয় করান চোখের বালিতে। ছবিগুলো অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানগুলোর প্রিয়মুখ হয়ে ওঠে, আন্তর্জাতিক উৎসবগুলোতেও স্থান পেতে শুরু করে। তার সিনেমায় অভিনীত তারকাদের তালিকায় ছিলেন অমিতাভ বচ্চন, শর্মিলা ঠাকুর, রাখী, প্রীতি জিনতা, সোহা আলি খান, অভিষেক বচ্চন, অর্জুন রামপাল, অজয় দেবগন, জ্যাকি শ্রফ, বিপাশা বসুসহ আরো অনেকে। সিনেমা থিয়েটারেও দর্শক বৃদ্ধিতে গুরুতর ভূমিকা পালন করেন। তবে সম্ভবত নিজের যৌন পরিচয় নিয়ে লড়াই করতে গিয়েই, তিনি সৃজনশীলতার অন্য পথের হদিস পেয়েছিলেন। তিনি ছিলেন বহুমনা এবং বহুপ্রতিভার লেখক, সম্পাদনা করতেন জনপ্রিয় বাংলা চলচ্চিত্র ম্যাগাজিন ‘আনন্দলোক’, এবং পরবর্তীতে বাংলা দৈনিক সংবাদ প্রতিদিন এর ‘রোববার’। এগুলোতে কাজ করতে গিয়ে তিনি নিজেকে জড়িয়েছিলেন বহুবিধ বিষয়ের সঙ্গে, যার মধ্যে ছিল কবিতা,সঙ্গীতা দত্ত দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন সেই দিন আর দূরে নয় যেদিন ঋতুপর্ণ ঘোষ পুনর্মূল্যায়িত হবেন বাংলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লেখক হিসেবে। ‘বার্ড অভ ডাস্ক’-এ ঋতুপর্ণের বন্ধু অপর্ণা সেন কথা বলেছেন তার খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসার অন্তঃবিক্ষোভ নিয়ে “আমি প্রায়ই ওকে জিজ্ঞেস করতাম ও আমার মতো হতে চায় কি না, লিঙ্গান্তর প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে চায় কি না, এবং ও সবসময়ই ‘না’ বলত।”
তারপরও, ২০০৯ সালে দিল্লি হাইকোর্ট থেকে আইপিসি’র সেকশন ৩৭৭ এর রায়প্রদানের পূর্বে তিনি প্রকাশ্যে ‘মেয়েলী পোশাক’ ও সাজসজ্জায় হাজির হতে শুরু করেছিলেন। ‘ক্রস ড্রেসিং’ ছাড়াও তিনি নিজের ট্রান্সজেন্ডার পরিচয় নিয়ে দৃঢ়।
সমকালীন সংস্কৃতিতে তার যে প্রভাব ছিল, তা কোনোভাবেই অগ্রাহ্য করা যাবে না। তার প্রথমদিকের নারীবাদী কাজগুলো থেকে শুরু করে শেষের কাজগুলোতে একের পর এক নতুন নতুন সব ‘ট্রেন্ড’ তৈরী করে গেছেন।

Share This Post

Subscribe To Our Newsletter

Get updates and learn from the best

More To Explore

Do You Want To express your thoughts

drop us a line and keep in touch