স্টিফেন হকিংসের ঈশ্বরবিহীন মহাবিশ্ব

Share This Post

পৃথিবীতে মানুষের সবচেয়ে মৌলিক প্রশ্ন সম্ভবত নিজের অস্তিত্ত্ব নিয়েঃ আমরা কোথা থেকে এসেছি, কোথায় যাবো, আমাদের জীবনের তাৎপর্য কী? সভ্যতার শুরু থেকে মানুষ এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে এসেছে। প্রাচীন গ্রীস থেকে শুরু করে হিন্দু ধর্ম, ইসলাম এবং খ্রিস্টান ধর্ম, চীনা এবং জাপানী ধর্মগুরুরা, ইনকা এবং মায়ান সভ্যতার মানুষগুলো – সবাই নিজেদের মতো করে মানুষ এবং বিশ্বসৃষ্টির ব্যাখ্যা দিয়ে এসেছে। এখনো আফ্রিকা কিংবা আমাজনের জঙ্গলে বিভিন্ন গোত্র পাওয়া যাবে যারা বিভিন্ন গাছপালা কিংবা চাঁদ-সূর্যকে তাদের ঈশ্বর মনে করে এবং তারা তাদের এই বিশ্বাস এর জন্যে জীবন দিতেও প্রস্তুত!

স্টিফেন হকিং খুব সাহসী একটা কাজ করে ফেলেছেন – যেটা তার স্বভাবের সাথে একদমই যায় না। তিনি সরাসরি বলেছেন – মহাবিশ্ব ‘সৃষ্টি’র পেছনে ঈশ্বরের কোন ভূমিকা নেই। মহাবিশ্ব পদার্থবিজ্ঞানের নিয়ম নীতি অনুসরণ করে স্বতস্ফুর্তভাবে তৈরি হয়েছে। মহাবিশ্বের উৎপত্তি এবং অস্তিত্বের ব্যাখ্যায় ঈশ্বরের আমদানি একেবারেই অযথা।

স্বভাববিরুদ্ধ, প্রথমেই সেটা বলে নিয়েছি। স্বভাবের সাথে যায় না বলেছি কারণ, হকিং তার পাঠকদের বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে ঠেলে দিয়ে ঈশ্বরকে নিয়ে মায়াবী কাব্য করতে পছন্দ করতেন। ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত তার বিপুল জনপ্রিয় বই – ‘ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম’ বৈজ্ঞানিক যুক্তিতে ভরপুর, এমনকি শূন্য থেকে কী ভাবে মহাবিশ্ব উদ্ভুত হতে পারে তারও সম্ভাব্য ধারনা আছে ওতে – কিন্তু বইয়ের শেষ লাইনটিতে এসেই প্যান্ডোরার বাক্সের মতোই রহস্যের ঝাঁপি মেলে দিয়েছিলেন হকিং ; বলেছিলেন – যেদিন আমরা সার্বজনীন তত্ত্ব (Theory of every thing) জানতে পারব, সেদিনই আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে ‘ঈশ্বরের মন’ (mind of god) কে পরিপূর্ণভাবে বোঝা।

উক্তি

তারপর থেকে হকিং এর বলা এই ‘মাইণ্ড অব গড’ নিয়ে হাজারো ব্যাখ্যা আর প্রতিব্যাখ্যা করা হয়েছে। কেউ বলেছেন ‘মাইণ্ড অব গড’ ব্যাপারটা হকিং তার বইয়ে কেবল কাব্যময় রূপক হিসেবে ব্যবহার করেছেন, সত্যিকার ঈশ্বরকে বোঝাননি, আবার আরেকদল বললেন, ‘মাইণ্ড অব গড’-এর মাধ্যমে হকিং ঈশ্বরের ব্যাপারটাতে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছেন। এতে নাকি প্রমাণিত হয়েছে যে বিজ্ঞানের দরবারে ঈশ্বর বলে সত্যই কিছু একটা আছে। তর্ক-বিতর্কে রঙ্গমঞ্চ জমজমাট ছিলো পুরোটা সময়েই কিন্তু কোন সমাধান পাওয়যা যায়নি। জ্যোতির্পদার্থবিদ পল ডেভিস তো একখানা ঢাউস বইই লিখে ফেলেছেন ‘মাইণ্ড অব গড’ শিরোনামে ১৯৯২ সালে। তবে হকিং কথিত ‘মাইণ্ড অব গড’ এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য কি ছিলো, উহা দ্বারা কি কি ব্যাখ্যা করা হইয়াছে – তাহা শুধু হকিং এর মস্তিস্কই বলিতে পারে। তবে দুর্মুখেরা বলেন, ‘মাইণ্ড অব গড’ নিয়ে অনর্থক ধোঁয়াশা সৃষ্টি করেছিলেন তার প্রথম বইয়ের পাবলিসিটি তথা প্রচারের স্বার্থে। ঐ মাইণ্ড অব গড নামক একটি বাক্যবন্ধের জন্যই নাকি বইয়ের কাটতি বেড়ে গিয়েছিলো বিশগুণ!

অবাক ব্যাপার হচ্ছে এবারে কিন্তু এই ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ অবস্থান থেকে পুরোপুরি সরে এসেছেন হকিং। তার নতুন বই ‘গ্রাণ্ড ডিজাইন’ (বিজ্ঞানী লিওনার্ড ম্লোডিনোর সাথে যুগপৎ ভাবে লেখা, এবং এই সপ্তাহেই প্রকাশিতব্য) -এ খুব চাঁচাছোলা ভাবেই বলেন –

আসলে হকিং এর বক্তব্যটা তিনি আলাদা করে কোথাও দেননি। লণ্ডনের টাইমস পত্রিকা তার এ সপ্তাহে প্রকাশিতব্য নতুন বইটি ফীচার করতে গিয়ে বইয়ের কিছু অংশ প্রকাশ করে সেপ্টেম্বর মাসের দুই তারিখে। সেখানেই ঈশ্বর সম্বন্ধে হকিং এর পরিবর্তিত ধারণা পাঠকদের সামনে উঠে আসে। টাইমসে প্রকাশিত সেই অংশবিশেষ থেকে দেখা যায়, হকিং বলছেন যে, বিগ ব্যাং কোন স্বর্গীয় হাতের ফসল কিংবা ফ্লুক ছিলো না। পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র মেনেই প্রাকৃতিকভাবে বিগ ব্যাং এর মাধ্যমে অনিবার্যভাবেই শূন্য থেকে মহাবিশ্ব উদ্ভুত হয়েছে।

বইয়ের প্রথম অধ্যায়েই লেখকদ্বয় ঘোষনা করেছেন “দর্শনশাস্ত্র মরে গেছে”! মানুষের অস্তিত্ত্ব কিংবা বাস্তবতা (reality) নিয়ে আগে দর্শনশাস্ত্র অনেক বড় বড় তত্ত্ব দিতো, কিন্তু বিজ্ঞান, বিশেষ করে পদার্থবিজ্ঞান, এর অগ্রগতির সাথে সাথে এই সব প্রশ্নের উত্তর এখন দর্শন শাস্ত্রের ধোঁয়াটে ও ঘোলাটে উত্তরের চেয়ে অনেক বেশি পরিস্কার এবং চমৎকারভাবে পাওয়া যায়। অনু পরমানুর কনা জগৎকে ব্যাখ্যা করার জন্যে কোয়ান্টাম মেকানিক্স নামে পদার্থবিজ্ঞানের চমৎকার একটা শাখা আছে। দুর্ভাগ্যক্রমে কোয়ান্টাম মেকানিক্স সম্ভবত বিজ্ঞানের সবচেয়ে কঠিন বিষয়গুলির একটি, কিন্তু এর মাধ্যমে প্রকৃতিকে যতো ভালোভাবে জানা যায় বিজ্ঞানের অন্য কোনো শাখার মাধ্যমে ততোটা ভালোভাবে জানা যায়না। “কমন সেন্স” বলে আমরা যে জিনিসটাকে সযত্নে লালন করি, যেটা না থাকলে মানুষজনকে আমরা উজবুক বলে গালি দেই, দুর্ভাগ্যজনকভাবে কোয়ান্টাম মেকানিক্স সে জিনিসটার বড়ই বিপরীত! একটা উদাহরণ দেইঃ আপনি যদি একটা ফুটবলকে কিক মারেন আপনি আশা করবেন ফুটবলটি কয়েক ফুট দূরে যেয়ে একটা জায়গায় যেয়ে থামবে। ফুটবলটা একটা নির্দিষ্ট পথ দিয়ে যেয়ে তার গন্তব্যে পৌঁছাবে। কিন্তু কোয়ান্টাম মেকানিক্স বলে যে ফুটবলটা আসলে ওই নির্দিষ্ট পথ ছাড়াও আরো অনেক পথে তার গন্তব্যে পৌঁছে থাকতে পারে। কিন্তু আমরা শেষ পর্যন্ত এর একটি পথই দেখি। ফুটবল জিনিসটা অনেক বড় দেখে আমরা এর অন্য পথগুলো দেখিনা। কিন্তু ফুটবলের জায়গায় যদি একটা ইলেক্ট্রন থাকতো তাহলে আমরা একটা এক্সপেরিমেন্ট দাঁড় করিয়ে সত্যি সত্যি দেখতে পারতাম যে ইলেক্ট্রনটি একাধিক পথ পাড়ি দিয়ে তার গন্তব্যে যেয়ে পৌঁছেছে! এটা পরীক্ষিত সত্য!!

বই

আরেকটা আন-কমনসেন্স এর ব্যাপার হচ্ছে স্থান এবং সময় (স্পেস-টাইম), এবং এটি তৈরি করেছে আইনস্টাইন এর জেনারেল থিওরী অব রিলেটিভিটি । আমাদের দৈনন্দিন জীবনে আমরা স্থান এবং সময়কে যেভাবে দেখি আসলে কিন্তু সেগুলি সেরকম নয়! স্থান এবং কাল বেঁকে যেতে পারে, লম্বা হতে পারে! মহাবিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বল হচ্ছে মহাকর্ষ (gravity), এবং এই বল স্থান এবং কালের বক্রতা ছাড়া কিছুই নয়। আমরা যেমন সময়কে একটা সরল রেখায় চলতে দেখি, আমাদের জীবনে সবকিছুর অতীত, বর্তমান, এবং ভবিষ্যৎকে সময়ের সাথে আবর্তিত হতে দেখি, আইনস্টাইন এর থিওরী অনুসারে সময় ব্যাপারটি সেরকম সরল রেখায় চলেনা। আমরা সেটি টের পাইনা কারণ আমাদের জীবনের প্রায় সবকিছু ঘটে এই ছোট পৃথিবীতে এবং আমাদের চারপাশের সবকিছুই মোটামুটি কাছাকাছি গতিতে চলে। একটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা পরিষ্কার হবেঃ ধরুণ আমি আর আপনি টিএসসি’র সামনে একটা টং দোকানে বসে চা খাচ্ছি। এই সময় হঠাৎ আমাকে একটা জরুরী কাজে কাছের একটা গ্যালাক্সিতে ছুটে যেতে হলো (কল্পনা শক্তির পূর্ন সদব্যাবহার!)। গ্যালাক্সি বলে কথা, আমি সিএনজি বেবি ট্যাক্সি না নিয়ে আমার স্পেসশিপে করে আমার গ্যালাক্সির দিকে রওয়ানা দিলাম। আপনাকে আমি কথা দিয়ে গেলাম আমি এক ঘন্টার মধ্যে ফিরে আসবো। এক ঘন্টার মধ্যে ওই গ্যলাক্সিতে যেতে হলে আমাকে প্রায় আলোর কাছাকাছি বেগে যেতে হবে। আমি আলোর প্রায় কাছাকাছি বেগে ওই গ্যালাক্সি থেকে আমার কাজ সেরে আপনার কাছে ফিরে আসলাম। আসার পর আপনার দিকে তাকিয়ে এক গাল হেসে বললাম আমি এক ঘন্টার মধ্যেই ফিরে এসেছি। কিন্তু আপনি আপনার ঘড়িতে খেয়াল করলেন আমি প্রায় দেড় ঘন্টা সময় কাটিয়ে এসেছি! আমি আপনাকে আমার ঘড়ি দেখালাম, সত্যি সত্যিই এক ঘন্টা কাটিয়ে এসেছি আমাই আমার ঘড়ির হিসেবে। তাহলে প্যাঁচটা কোথায় লাগলো?

সমস্যাটা হয়েছে আমি যখন আলোর কাছাকাছি বেগে ট্রাভেল করেছি। কোনো কিছুর গতি যখন আলোর গতির কাছাকাছি চলে যায় তখন তার সময় ধীর গতিতে চলতে থাকে, আলোর গতিতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সময় একেবারে থেমে যায়। তাই আমি যখন কাছের গ্যলাক্সিতে আলোর কাছাকাছি বেগে ভ্রমন করে এসেছি তখন আমার সময় আর আপনার সময় আসলে এক ছিলোনা। অতএব, সময় সম্পর্কে আমাদের যে দৈনন্দিন জীবনের ধারণা সেটি আসলে চরম সত্যি নয়।

হকিং এবং মেলাডনো মনে করেন যে “বিশ্ব জগতের শুরু কোথায় এবং কখন হয়েছিলো?” এই ধরণের প্রশ্ন আসলে বৈজ্ঞানিকভাবে ঠিক প্রশ্ন না। “কোথায়” এবং “কখন” বলতে যে স্থান এবং সময় এর কথা বুঝানো হয় সেই জায়গা এবং সময়েরই সৃষ্টি হয়েছিলো বিশ্ব সৃষ্টির সাথে সাথে। অতএব, সময় “কখন” সৃষ্টি হয়েছিলো এবং তার আগে কী ছিলো এই প্রশ্নটি হকিং এর মতে “দক্ষিন মেরুর দক্ষিনে কী আছে?” এর মতো। হকিং (এবং মেলাডনো) এর মতে সৃষ্টির শুরুতে স্থান এবং সময় এর মধ্যে কোনো পার্থক্য ছিলোনা, তাই অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতের ব্যাপারটা সেখানে আসেনা।

প্রতিভাবান পদার্থবিজ্ঞানী রিচার্ড ফিনম্যান এর মতে সব বস্তুকনার প্রায় অসীম সংখ্যক অতীত আছে। কোনো বস্তুর বর্তমান কিংবা ভবিষ্যৎ এর সব অতীতে ইতিহাস থেকে কোয়ান্টাম সমীকরণ দিয়ে বের করা যায়। হকিং ফিনম্যান এর থিওরীকে উলটা দিক থেকে প্রয়োগ করেছেন আমাদের মহাবিশ্বের ক্ষেত্রে। অর্থাৎ মহাবিশ্বের বর্তমান থেকে এর অতীতকে বের করার চেষ্টা করছেন। ফিনম্যানের থিওরী এর সাথে আইনস্টাইনের জেনারেল থিওরী অব রিলেটিভিটি মহাবিশ্বের উপর প্রয়োগ করে হকিং এবং মেলাডনো দেখেছেন মহাবিশ্বের সৃষ্টির সময়ে স্থান এবং সময়ের মাত্রার মধ্যে কোনো পার্থক্য ছিলোনা, দুটোই একই রকম আচরণ করেছিলো সৃষ্টির সময়।

সময়ের শুরু এর ব্যাপারটির মিমাংসা হয়ে যাওয়ার পর যে প্রশ্নটি থাকে সেটি হলো “কেনো এই মহাবিশ্বের সৃষ্টি হলো?”। হকিং বলছেন, সেটিও বিজ্ঞানের ভেতরে থেকেই উত্তর দেওয়া যায় ঈশ্বর কিংবা দেব-দেবীর সাহায্য না নিয়ে!

পৃথিবীজুড়ে পদার্থবিজ্ঞানীদের স্বপ্ন “সবকিছুর তত্ত্ব” এর সন্ধান পাওয়া। এই তত্ত্ব দিয়ে পদার্থবিজ্ঞানের সবকিছু একই ধরণের সমীকরণ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাবে। কিছুদিন আগ পর্যন্তও এটা অনেকটা অধরা মনে হলেও সাম্প্রতিক কালে M-থিওরী নামে একটা তত্ত্ব (এটা আসলে অনেকগুলো তত্ত্বের একটা সেট) বিজ্ঞানীদের সেই আশার আলো দেখাচ্ছে। M-থিওরী এর শুরু স্ট্রিং থিওরী নামে, এটি বলে যে আমাদের মহাবিশ্ব আসলে একটা এগারো মাত্রিক মহাবিশ্ব – দশটি স্থান এবং একটি সময়। আমরা মাত্র তিনটা স্থান মাত্রা দেখি কারণ অন্য সাতটি মাত্রা সংকুচিত হয়ে গিয়েছে মহাবিশ্বের সৃষ্টির সময়। এটা কেনো হয়েছে সেটা নিয়ে এখনো নিশ্চিত কিছু বলা যাচ্ছেনা, কিন্তু এই M-থিওরী দিয়ে আমাদের মহাবিশ্বের সবকিছু ব্যাখ্যা করে যায় খুব চমৎকারভাবে!

হকিং

আমাদের এই মহাবিশ্ব যে প্রাণ সৃষ্টির জন্যে এতো অনুকুল – মহাকর্ষ ধ্রুবক, ইলেক্ট্রন এর ভর এবং চার্জ, মৌলিক বলগুলোর বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি কোনো কিছু একটু এদিক ওদিক হলে এই মহাবিশ্বে প্রাণের সৃষ্টি হতে পারতো না- এর মানে এই নয় যে আমরাই একমাত্র সৃষ্ট জগৎ। M-থিওরী অনুসারে কোয়ান্টাম জগতের ফ্লাকচুয়েশনের কারণে আমাদের মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়েছে শূন্য থেকে, এবং আমাদের মহাবিশ্বের সাথে আরো প্রায় ১০৫০০ মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়েছে। এই মহাবিশ্বের একেকটির একেক রকম পদার্থবিজ্ঞান, যেমন কোনোটার হয়তো মাত্রার সংখ্যা দুইশ, ইলেকট্রন হয়তো একটা ফুটবলের মতো, হয়তো মানুষগুলো মাথার উপর ভর করে হাঁটে (যদি মানুষ থেকে থাকে আর কি)। আমরা এখন মহাবিশ্ব নিয়ে কথা বলছি এর মানে ঘটনাক্রমে আমাদের মহাবিশ্বের পদার্থবিজ্ঞান মানুষ সৃষ্টির অনুকুল! কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন হচ্ছে ভ্যাকুয়াম (শূন্য) থেকে খুবই স্বল্প সময়ের জন্যে শক্তির তৈরি হওয়া। শূন্য থেকে মহাবিশ্ব সৃষ্টির এই ধারণা আসলে বেশ কিছুদিন ধরেই বলা হচ্ছিলো।

অতএব, আমাদের পুরনো প্রশ্নে ফিরে আসিঃ কেনো আমাদের এই মহাবিশ্বের সৃষ্টি হলো? হকিং এর মতে, কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন এর মাধ্যমে শূন্য থেকে বস্তু তৈরি হতে পারে যার শক্তি হচ্ছে পজেটিভ। সেই পজেটিভ শক্তিকে ব্যলান্স করার জন্যে (শক্তির নিত্যতার সূত্রঃ শক্তির কোনো সৃষ্টি বা বিনাশ নেই, মহাবিশ্বের মোট শক্তির পরিমাণ শূন্য) আছে মহাকর্ষ বল যেটি স্থান এবং সময়ের একটা বৈশিষ্ট্য মাত্র। মহাকর্ষের নেগেটিভ শক্তি বস্তুর পজেটিভ শক্তিকে ক্যান্সেল করে দিয়ে শক্তির নিত্যতা বজায় রাখে। মহাবিশ্বের এই সৃষ্টি প্রক্রিয়া স্বতস্ফুর্ত, কোনো বাহ্যিক হস্তক্ষেপের প্রয়োজন ছাড়াই মহাবিশ্বের সৃষ্টি হতে পারে। অতএব, শূন্য থেকে ইচ্ছা মতো মহাবিশ্ব তৈরি হতে পারে, কোনো ঈশ্বরের দরকার নাই সে জন্যে! হকিং এর মতে ঈশ্বরকে দিয়ে মহাবিশ্বের সৃষ্টি করানো মানে প্রশ্নটাকে এক ডিগ্রী উপরে উঠিয়ে দেওয়া, মহাবিশ্ব কে সৃষ্টি করেছেন সেটি প্রশ্ন না করে এখন প্রশ্ন করা হবে ঈশ্বরকে কে সৃষ্টি করেছেন। তবে সাধারণত ফার্স্ট-কজ আরগুমেন্ট নামে একটি যুক্তি – ঈশ্বর সবসময়ই ছিলো এবং থাকবে, তাকে সৃষ্টি করার প্রয়োজন পড়ে না – দিয়ে ঈশ্বরকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা হয়। হকিং বলছেন, ঈশ্বরকে না এনে কিভাবে বিশ্ব সৃষ্টি ব্যাখ্যা করা যায় সেটাই তাদের এই বই এর উদ্দেশ্য।

অনেক বিজ্ঞানী এবং দার্শনিকেরাই মনে করেন, আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান যখন একেবারে শূন্য থেকে বিশ্বসৃষ্টির একটি প্রাকৃতিক এবং যৌক্তিক সমাধান দিতে পারছে, তখন ঈশ্বর সম্ভবত একটি ‘বাড়তি হাইপোথিসিস’ ছাড়া আর কিছু নয়। বিজ্ঞানী ভিক্টর স্টেঙ্গর, লরেন্স ক্রাউস, এলেন গুথ, আদ্রে লিন্ডেরা সেটা অনেক আগে থেকেই বলে আসছিলেন (মুক্তমনাতেও এ নিয়ে বহু লেখা প্রকাশিত হয়েছিল )। হকিংও শেষপর্যন্ত সেই একই সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন। ঈশ্বর হাইপোথিসিস মোটা দাগে অক্কামের ক্ষুরের পরিস্কার লংঘন। তিনি নিজেই সেটা বলেছেন এভাবে,

স্টিফেন হকিং এর এই ‘স্বভাববিরুদ্ধ’ বক্তব্য নিয়ে সারা মিডিয়া এখন তোলপাড়। ধার্মিকরা স্বভাবতই আশাহত হয়ে গালির তুবড়ি ছুটিয়ে চলেছেন খবরটি প্রকাশের পর থেকেই। তারা বলছেন, মহাবিশ্ব কিভাবে শূন্য থেকে তৈরি হতে পারে বিজ্ঞান না হয় এখন তা ব্যাখ্যা করতে পারে, কিন্তু কেন মহাবিশ্বের সৃষ্টি – তা নাকি বিজ্ঞান বলতে পারে না। আর অবধারিতভাবে তাদের কাছে উত্তর – ‘ঈশ্বর’!

লিখেছেন : উমাশ্রী রায় (ইন্টার্ন)

Share This Post

Subscribe To Our Newsletter

Get updates and learn from the best

More To Explore

Do You Want To express your thoughts

drop us a line and keep in touch