[ পরবর্তী অংশ ]
আলোচনা প্রসঙ্গে ‘গুপী গাইন ও বাঘা বাইন’ নামটা আসে,এই বছর সেই ছবির অর্ধশতবর্ষপূর্তি।সেই উপলক্ষ্যে কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব ২০১৯-এ এই ছবি বিশেষভাবে দেখানো হয়।ভারতীয় সিনেমার জগতে ‘গুগাবাবা’ একটি যুগান্তকারী সৃষ্টি। উপেন্দ্রকিশোর রচিত এই গল্পটি সত্যজিৎ রায় ঠাকুরদার জন্ম শতবর্ষেই করতে চেয়েছিলেন ১৯৬৩ তে।কিন্তু কোনো কারণে সেটা হয় ১৯৬৮ তে এবং প্রকাশিত হয় ১৯৬৯ এর মে মাসে।এই ছবির মূল বিষয়ে প্রধানত শান্তির বাণী প্রচারিত হয়েছে বলে মনে হলেও আদৌতে সেটা নয় বলেই পরিচালক স্বয়ং দাবী করেছেন।১৯৮৮তে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন,”ছোটোদের জন্য ছবি বাংলায় প্রায় হয় না বললেই চলে,সেই অভাব দূর করার ইচ্ছে আমার মনে অনেকদিন ধরেই উঁকি দিচ্ছিলো।তাছাড়া আমার নিজের ত্রয়োদশ বর্ষীয় পুত্র সন্দীপও এই ছবি করার একটা কারণ।এখন অবধি ওর উপযোগী কোনো ছবি আমি করিনি। আমি যখন ছবিটি করি তখন আমার মনে তেমন কোনো ধারণা ছিলো না। আমি কেবল মজাদার একটি গল্প বলতে চেয়েছিলাম।”
যে মানুষটি বড়ো হয়ে উঠেছিলেন নির্বাক চলচ্চিত্রের যুগে,তিনিই পরবর্তীকালে ভারতের প্রথম মিউজিক্যাল ছবি তৈরী করলেন। ভারী আশ্চর্য সেই ঘটনা। তাঁর প্রথম দিকের ছবিতে ভারতের তাবড় তিনজন সঙ্গীতকার সঙ্গীত পরিচালনা করেন-পন্ডিত রবিশঙ্কর,ওস্তাদ বিলায়েত খান ও ওস্তাদ আলি আকবর খান।এখানে দেখা যায় তিনজনই বাঙালী শিল্পী।এক্ষেত্রেও সত্যজিৎ রায় ভারতীয় উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের ধারায় কোথাও বাংলার সত্ত্বাকে হারাতে পারেননি।তাই ‘তিনকন্যা’ থেকে নিজেই সঙ্গীত পরিচালনা করেন। ‘দেবী’ ছবির জন্য গীতরচনা করেন।শ্যামাসঙ্গীত ‘ মা মা বলে আর ডাকবো না’,তবে সুর ছিল রামপ্রসাদী।এই নিয়ে সত্যজিৎ রায়ের মা সুপ্রভা যথেষ্ট আপত্তি করেছিলেন,ছেলে ব্রাহ্ম হয়ে শ্যামাসঙ্গীত লিখেছিল বলে। সেই সত্যজিৎ রায় সঙ্গীত পরিচালক জীবনের প্রথম ধাপেই গুপী গাইনের মতো অসামান্য এক সঙ্গীত সৃষ্টি করেন। এই ছবির প্রত্যেকটি গান নিজস্বতা বজায় রাখে। এই ছবিটির প্রতিটি বিষয়ই নিজস্বতা তৈরী করতে সক্ষম।সেই গান আসলে কল্পনা জগতের গান,কিন্তু সেগুলো যদি বাস্তব হতো কি ভালোই না হতো। বাংলার লোকসুর থেকে নিখুঁত দক্ষতার সাথে বাছাই করে তৈরী করেছিলেন সেই সব সুর। তাই বলে এই না যে ছবির প্রয়োজনে অন্যসুর ব্যবহার করেন নি,নিশ্চয়ই করেছেন। ভূতের দলের নাচের দৃশ্য তার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। তবে ভূতের রাজা যেমন বাংলাদেশের ভুতের রাজা এবং সে যখন বর দিয়েছে তখন তাদের গানে বাংলার সুর থাকাটাই সবচাইতে স্বাভাবিক।‘দেখো রে নয়ন মেলে’ যেভাবে ভৈরবীর ব্যবহার করা হয়েছে,সেটা কিন্তু ‘ ভূতের রাজা দিল বর’ গানে নেই। এছাড়াও বাঘার আনকোরা গলায় মাঝে মাঝে গান,এটাও যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ।অনুপ ঘোষালের দক্ষ স্বরের বিপরীতে রবি ঘোষের সেই স্বর।
এমন বহুবিষয় বাদ থেকে যায়,যা নিয়ে আলোচনা করে চলে যেমন সত্যজিৎ-এর নিত্যদিনের জীবনে সব থেকে পছন্দের যেটা ছিল সেটা হলো খাওয়া। ভোজনরসিক কথাটা উপযুক্ত না হলেও যথেষ্ট ভোজনপ্রিয় ছিলেন। সেটা তাঁর করা অনেক সিনেমা ও সাহিত্যেও বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। নিঃসন্দেহে গুপীগাইন তার আদর্শ উদাহরণ।ইন্ডিয়ান,কন্টিনেন্টাল, বাঙালী কোনো খাবারেই না ছিল না তাঁর। শুটিং এর সেটে রীতিমতো আসর বসতো লাঞ্চের সময়।তবে বাড়িতে খুব সাধারণ খাওয়া সারতেন। তাঁর পুত্রবধূ ললিতা স্মৃতিচারণায় লিখেছেন,“লুচির সাথে অড়হর ডাল খেতে ভীষণ ভালোবাসতেন,…ভাতে-ভাত ! ব্রাহ্মদের বিশেষদিনে ভাতে-ভাত খেতে হতো।উনি মনে করিয়ে দিতেন।” এছাড়াও ভালোবাসতেন নলেন গুড়ের সন্দেশ। অস্কার পাওয়ার পর খেতে চেয়েছিলেন,কিন্তু সেটা আর হয়ে ওঠে নি।
(ক্রমশঃ)