ধর্ম বরাবরই ভারতবর্ষের অন্যতম প্রাসঙ্গিক প্রসঙ্গ। ধর্ম ছাড়া ভারতীয় সাধারণ জীবন প্রবাহ সম্ভব এই ভাবনা এখন বিরল। এই সমকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ধর্মের প্রাসঙ্গিকতা বাড়ছে প্রতিদিন। যেখানে রাজনীতি ধর্ম ছাড়া অচল। সেখানে দাঁড়িয়ে বাঙালির গুরু বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দৃষ্টিতে ধর্মের পরিভাষা কী তা জেনে নেওয়া জরুরী।
শুরুতেই বলাবাহুল্য রবীন্দ্রনাথ বেদ-বাইবেল থেকে কোরান শরিফ পর্যন্ত পৃথিবীর সব ধর্মগ্রন্থ পড়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ পড়ে অনুভব করেছিলেন সব ধর্মগ্রন্থ প্রায় একই কথা বলছে — কীভাবে ভালোবাসার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা যায়! রবীন্দ্রনাথের কাছে ধর্মের পরিভাষা অনেক গভীর এবং অনন্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মতো। রবীন্দ্রনাথের ধর্মচর্চা অথবা ধর্ম বিষয়ক পড়াশোনা শুধু হয়েছিল ছোটবেলাতেই। তার পিতার হাত ধরে। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর পুত্রদের বেদ এবং উপনিষদের শ্লোকগুলো আবৃত্তি করাতেন। রবীন্দ্রনাথের বাবা ছিলেন ব্রাহ্ম আন্দোলনের পুরোধা। এছাড়া রাজা রামমোহন রায়ের অনুরাগী। দেবেন্দ্রনাথের জীবনে বেদ, উপনিষদ ছিল আদর্শ। বাবার এই উপনিষদ শিক্ষা এবং জ্ঞান গভীর প্রভাব ফেলেছিল রবীন্দ্রনাথের জীবনে। ধর্ম সচেতনতার জন্য মাত্র ২৩ বছর বয়সে ব্রাহ্ম সমাজের সেক্রেটারি পদে নিয়োগ করা হয় রবীন্দ্রনাথকে। রবীন্দ্রনাথের সমাজ সচেতনতার জন্য হিন্দু সমাজের গোঁড়ামিগুলোর বিরুদ্ধে বারবার আওয়াজ তুলেছেন, কলম তুলেছেন। বিপরীতে হিন্দু সমাজ ব্রাহ্ম সমাজকে নিয়েও সমালোচনা করতেন। ফলে একে ওপরের রুচিশীল সমালোচনা চলত দীর্ঘ দিন। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় হিন্দু সমাজ এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রাহ্ম সমাজ নিয়ে নিয়মিত দু’টো ভিন্ন পত্রিকায় সমানুপাতিক ভাবে লেখালেখি চলতো। তবে এই সমস্তটা পেরিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন —”কোন প্রতিষ্ঠানিক ধর্ম আমার ধর্ম নয়। আমি ব্রাত্য, আমি মন্ত্রহীন, আমি পঙক্তিহীন, আমি তোমাদেরই লোক।”
“মানুষের ধর্ম” বইতে রবীন্দ্রনাথ মানুষের ভিতর দুরকম ধর্মের অস্তিত্বের কথা বলেছেন। প্রথমটি নিতান্ত প্রাকৃতিক তথা জৈব ধর্ম, যে ধর্মে শারীরিক প্রয়োজনই সব। আর দ্বিতীয়টি হলো জীবসত্তাকে ছাড়িয়ে গিয়ে মানবধর্মের জাগরণ হওয়ার ফলে প্রাণীজগতের স্বভাবধর্ম থেকে মানুষের ধর্মে উত্তরণ ঘটে মানবজাতির। অর্থাৎ আমরা বুঝতে পারছি প্রাণীর ধর্ম শরীর হইতে মন সর্বত্র বিরাজমান। মানব সভ্যতাকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য যে সূক্ষ্ম প্রয়োজনগুলো আছে তার মধ্যে ধর্ম তার অন্যতম। কারণ ধর্মই মানুষকে ভাবতে শেখাচ্ছে জীবনের উদ্দেশ্য কী। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবনকে এক যাত্রা বলেছেন। যে যাত্রা আমাদেত গন্তব্যর দিকে নিয়ে যাবে। সেই গন্তব্যকে নির্ধারণ করবার জন্য ধর্মের প্রয়োজনীয়তা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রদীপের কথা বলছেন। একটি প্রবন্ধে বলছেন প্রদীপ জ্বালাবার জন্য জরুরি তেল, তুলো এবং আগুন। এই তিনের আয়োজনে প্রদীপ জ্বলবে। আর সূর্য তার আলোয় আমাদের আলোকিত করছে প্রতিনিয়ত। শুধু চোখ খুলে আকাশ পানে চাইতে হবে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই লেখনীতে প্রদীপ এবং সূর্য রূপক হিসেবে ব্যবহৃত। রবীন্দ্রনাথ বলছেন ধর্মের বা জ্ঞানের আলো জ্বালাবার জন্যকে এত আয়োজনের প্রয়োজন নেই। যে আলো আমাদের ভিতরে বিরাজমান তাকে খুঁজতে অযথা পৃথিবীর ইতস্তত বিভিন্ন পদার্থের কাছে উপস্থিত হওয়ার তো প্রয়োজন নেই। তাই এই সমস্ত ছেড়ে প্রয়োজন নিজের অন্তরে একবার তাকানো। যেখানে হয়তো সব প্রশ্নের উত্তর আছে। এভাবেই বলা যায় ধর্মের সন্ধানে আমাদের প্রয়োজন নেই মন্দির,মসজিদের দ্বারস্থ হওয়া। সমসাময়িক রাজনৈতিক এবং সমাজের কাছে ধর্মের থেকে ধর্মের বর্ম বেশি। রবীন্দ্রনাথের সময়ও রাজনৈতিক কারণে ধর্মের ব্যবহার হয়ে আসছে ফলে রবীন্দ্রনাথ তাঁর গেদু মিয়াকে বলছে— “ওরা ধর্মকে ব্যবহার করে স্বার্থ লুটতে চায়।”
রবীন্দ্রনাথ ব্যক্তিসত্তাকে অহং আর ব্যক্তির ভিতরের অর্থাৎ অন্তর্গত সত্তাকে বলেছেন আত্মা। তুলনা করেছেন, ব্যক্তিসত্তাকে যদি বলি প্রদীপ, তো আত্মা হচ্ছে তার শিখা। অন্তর্গত সত্তার কথা বারবার ফিরে ফিরে এসেছে রবীন্দ্রনাথের কবিতায়-গানে। গানের দৃষ্টান্তে, যেখানে অন্তর্বাসী সত্তাকে জাগ্রত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন কবি বলছেন— “মোর হৃদয়ের গোপন বিজন ঘরে/একেলা রয়েছ নীরব শয়ন-পরে—/প্রিয়তম হে, জাগো জাগো জাগো।”
প্রবন্ধ থেকে রবীন্দ্রনাথের অন্যান্য সাহিত্যে ধর্মের প্রভাব গভীর। রবীন্দ্রনাথ বলছেন মানুষের সৃষ্টি বড়ই জটিল।আমাদের সংসার থেকে আমাদের জীবনযাপনও জটিল।ফলে যে মানুষ এতটাই জটিল তারা মুক্তির পথ সহজে দেখায় কী করে! দার্শনিক গ্রন্থ শুধুই আমাদের তার জটিলতা দিয়ে বিস্ময় করে। পথ বাতলে দেয় না। পথ বাতলে দেয় সেই সব সরলতম ব্যখ্যা,যা আমাদের জন্য আদর্শ। এই আদর্শের কাছে আমাদের নতজানু হতে হবে। তাই কবিতার মধ্য দিয়ে কবি নানান ভাবে খোঁজার চেষ্টা করেছেন তার ঈশ্বরকে। অন্ধকার মুছতে হলে শুধু অন্ধের মতো খুঁজে চললে হবে না। নিজের কাজের মধ্যে দিয়ে তাকে খুঁজতে হবে। মানবতার জয়ের জন্য রবীন্দ্রনাথ বরাবর মুক্তির পথে কাজকে কখনো দূরে ঠেলে দেয়নি বরং সাধারণ জীবনের সাথে ধর্মের সুতো জুড়ে দিয়েছেন। “কালান্তর” গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ ধর্ম আর ধর্মতন্ত্রের বৈপরীত্য নির্দেশ করেছেন বিস্তৃতভাবে। রবীন্দ্রনাথ লিখছেন—”ধর্ম বলে, মানুষকে যদি শ্রদ্ধা না করো তবে অপমানিত ও অপমানকারী কারোরই কল্যাণ হয় না। কিন্তু ধর্মতন্ত্র বলে, মানুষকে নির্দয়ভাবে অশ্রদ্ধা করিবার বিস্তারিত নিয়মাবলী যদি নিখুঁত করিয়া না যান তবে ধর্মভ্রষ্ট হইবে।ধর্ম বলে, অনুশোচনা ও কল্যাণ কর্মের দ্বারা অন্তরে বাহিরে পাপের শোধন। কিন্তু ধর্মতন্ত্র বলে, গ্রহণের দিনে বিশেষ জলে ডুব দিলে, কেবল নিজের নয়, চোদ্দপুরুষের পাপ উদ্ধার।”
“ধর্ম আমাদের পক্ষে সর্বশ্রেষ্ঠ আবশ্যক সন্দেহ নাই—কিন্তু সেইজন্যই তাহাকে নিজের উপযোগী করিয়া লইতে গেলেই তাহার সেই সর্বশ্রেষ্ঠ আবশ্যকতাই নষ্ট হইয়া যায়। তাহা দেশকালপাত্রের ক্ষুদ্র প্রভেদের অতীত, তাহা নিরঞ্জন বিকারবিহীন বলিয়াই তাহা আমাদের চিরদিনের পক্ষে আমাদের সমস্ত অবস্থার পক্ষে এত একান্ত আবশ্যক। তাহা আমাদের অতীত বলিয়াই তাহা আমাদিগকে নিত্যকাল সমস্ত পরিবর্তনের মধ্যে ধ্রুব অবলম্বন দান করে।” — মানব সভ্যতাকে পথ বাতলে দিচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ। যার জীবনের সুখ দুঃখ প্রতিনিয়ত বিরাজমান। বেদনার জলোচ্ছাসে ভেঙে পড়া অন্তরে তাঁর দেখা পাওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ফলে তাঁর লেখায় আমরা তার প্রতিচ্ছবি দেখেছি বারবার। অন্তরে যেভাবে ধর্ম এবং নিজের দেবতার প্রতি তার অনুরাগ ছিল সেই বিশ্লেষণ তাঁর সাহিত্য পড়লেই বোঝা যায়। ভারতীয় দৃষ্টিতে সাধারণত যেভাবে দেবতা পূজ্য তার থেকে অনেক একান্তে রবীন্দ্রনাথ নিজের সঙ্গে দেবতাকে জুড়ে দেখিয়েছেন। কিন্তু সমকালীন রাজনৈতিক এবং সমাজিক পরিস্থিতি রবীন্দ্রনাথকে সমাজের প্রতি আরও বলতে বাধ্য করেছে।
রবীন্দ্রনাথ চিঠিতে লিখছেন — “যেখানে মন্দিরের দেবতা মানুষের দেবতার প্রতিদ্বন্দ্বী, যেখানে দেবতার নামে মানুষ প্রবঞ্চিত সেখানে আমার মন ধৈর্য্য মানে না।দেশের লোকের শিক্ষার জন্যে, অন্নের জন্যে, আরোগ্যের জন্যে এরা কিছু দিতে জানে না, অথচ নিজের অর্থ-সামর্থ্য,সময়,প্রীতি-ভক্তি সবই দিচ্ছে সেই বেদীমূলে যেখানে সবই নিরর্থক হয়ে যায়। মানুষের প্রতি মানুষের এত নিরৌৎসুক্য, এত ঔদাসীন্য অন্য কোনো দেশেই নেই, এর প্রধান কারণ এই যে, এ দেশে হতভাগা মানুষের সমস্ত প্রাপ্য দেবতা নিচ্ছেন হরণ করে।” এই কথাগুলো আজও প্রাসঙ্গিক। এই শতাব্দীর রাজনৈতিক পরিস্থিতি একই চেতনার একই উদ্দেশ্যের ভুক্তভোগী। যে রবীন্দ্রনাথের লেখা রাজনৈতিক সভায় কোট করা হয়,সেই রবীন্দ্রনাথের মতাদর্শ থেকে ওরা অনেক দূর। ওরা রবীন্দ্রনাথ পড়েনি। রবীন্দ্রনাথকে ভুলভাবে প্রাসঙ্গিকতায় তুলে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে শুধুমাত্র।
মানুষ যদি রাজনৈতিক ভাষণে রবীন্দ্রনাথের কোটেশন শোনা বন্ধ করে এবং বাড়িতে রবীন্দ্রনাথের বই পড়া শুরু করে তাহলে শুধুই রবীন্দ্রনাথের মতাদর্শ নয় সঙ্গে নিজের চেতনায় সঠিক দেবতার স্থাপনা করা যেতে পারে। রবীন্দ্রনাথ চিরকালীন প্রাসঙ্গিক হয়ে থেকে যাবে। কিন্তু সেই প্রাসঙ্গিকতা থেকে আমরা কী শিখে নিচ্ছি সেটা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। রবীন্দ্রনাথের লেখা কোন ধর্মগ্রন্থ থেকে কম নয়,পড়লে অন্তরে চেতনায় ঈশ্বরের নবজাগরণ হয়। রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে ধর্ম মানুষকে অনেক কিছু শেখায়। সেই জ্ঞান যদি আমরা উপভোগ করতে পারি তাহলে শান্তি, একতা এবং ভালোবাসার সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতীক হয়ে উঠবে ভারতবর্ষ।
লেখক পরিচিতি : বিশ্বরূপ হাওলাদার