পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি জাতিই নিজেদের ইতিহাস সংস্কৃতিকে বরনের জন্য বিশেষ বিশেষ দিনকে স্মরণীয় করে রাখে।
যেমন প্রাচীন আরবীয়রা ‘ওকাজের মেলা’, ইরানী’রা ‘নওরোজ উৎসব’ ও প্রাচীন ভারতীয়রা ‘দোলপূর্ণিমায়’ নববর্ষ উদযাপন করে থাকত। ( উল্লেখ্য, ইরানী’রা এখনো অনেক ঘটা করেই নওরোজ উৎসব পালন করে থাকে)। এখানে বলে রাখা ভাল, পূর্বপাকিস্তান সব সময়ই বাঙালি সংস্কৃতিকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করত। রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গান প্রকাশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারীর প্রতিবাদে ১৯৬৫ সাল ( ১৩৭৫ বঙ্গাব্দে) ছায়ানট নামের একটি সংগঠন রমনা পার্কে পহেলা বৈশাখ বর্ষবরণ উৎসব পালনের আয়োজন করে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এসো হে বৈশাখ……এসো , এসো….গানের মাধ্যমে তারা স্বাগত জানাতে শুরু করে নতুন বছরকে।বর্ষবরন এগিয়ে যায় আরো এক ধাপ। বিস্তৃত হতে শুরু করে ছায়ানট নামের সংগঠনটির। যা এখন বাংলাদেশের সংস্কৃতির ক্ষেত্রে একটি মহিরূহে পরিণত হয়েছে। ১৯৭২ সালের পর থেকে রমনা বটমূলে বর্ষবরণ জাতীয় উৎসবের স্বীকৃতি পায়। ১৯৮০ সালে বৈশাখী মঙ্গল শোভাযাত্রার মাধ্যমে এক ধাপ বাড়তি ছোঁয়া পায় বাংলা নববর্ষ বরণের অনুষ্ঠান। ছড়িয়ে পড়ে সবার অন্তরে অন্তরে। প্রতি বছরই তাই কোটি বাঙালির অপেক্ষা থাকে কবে আসবে বাংলা নববর্ষ।
প্রাচীন বাংলার রাজা শশাঙ্কের আমল থেকেই বাংলা সন গণনা শুরু। তাঁর শাসনামল সম্ভবত ৫৯০ থেকে ৬২৫ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। পশ্চিম বাংলা, বর্তমান বাংলাদেশ, বিহার, উড়িষ্যা ও আসাম নিয়ে ছিল তাঁর রাজ্য। জুলিয়ান পঞ্জিকা অনুসারে বাংলা বর্ষগণনা শুরু হয় ১২ এপ্রিল সোমবার ৫৯৩ এবং গ্রেগরিয়ান পঞ্জিকা-মতে একই সালের ১৪ এপ্রিল সোমবার। সূর্য-সিদ্ধান্তের ওপর ভিত্তি ক’রে রচিত হিন্দু ‘সোলার ক্যালেন্ডার’ থেকেই বাংলা কালেন্ডারের উৎপত্তি।
মোঘল সম্রাট আকবর (শাসনামল, ১৫৫৬ থেকে ১৬০৫) কর আদায়ের উদ্দেশ্যে নতুন বাংলা ক্যালেন্ডার প্রচলন করেন। এর আগে মুসলিম শাসনামলে কৃষি ও ভূমিকর আদায় করা হতো ইসলামিক হিজরী ক্যালেন্ডার অনুসারে। হিজরী পঞ্জিকা সৌর নির্ভর হওয়ায় কৃষিবছর ও অর্থবছর একই সময়ে হতো না। তাই, অসময়ে কর পরিশোধ করতো হতে ব’লে কৃষকদের কষ্টের সীমা ছিলনা। সহজে কর আদায়ের উদ্দেশ্যে সম্রাট আকবর ক্যালেন্ডার সংশোধনের নির্দেশ দিলেন। নির্দেশমত সে সময়ের বিখ্যাত পন্ডিত, রাজ জ্যোতিষি ও সম্রাটের উপদেষ্টা আমীর ফাতেউল্লাহ সিরাজী সৌর-হিন্দু ও চান্দ্র-হিজরী ক্যালেন্ডারের ওপর ভিত্তি করে নতুন ক্যালেন্ডার তৈরি করলেন। নতুন বাংলা ক্যালেন্ডারের প্রচলন হলো পরবর্তী ফসল কাটার সময় যখন কৃষকেরা অপেক্ষাকৃত অর্থনৈতিকভাবে ভাল অবস্থায় ছিলেন। ফসল কাটার সময়কাল স্মরণে রেখে তৈরি ব’লে শুরুর দিকে এটা ‘হারভেস্ট ক্যালেন্ডার’ বা ‘ফসলী সন’ বলে পরিচিত ছিল। মোঘল আমলে বাংলা ক্যালেন্ডারকে সাম্রাজ্যব্যাপী সরকারী মর্যাদা দেয়া হয়। হিন্দু জ্যোতিষশাস্ত্র-সম্মতভাবেই রাখা হয় মাসগুলোর নাম।
বাংলা ঋতু
দুই মাসে একটি ক’রে মোট ছয়টি ঋতু আছে বাংলা ক্যালেন্ডার বা পঞ্জিকায়। প্রথম মাস বৈশাখ থেকে শুরু হয় গ্রীষ্ম ( বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ) এরপর বর্ষা (আষাঢ়, শ্রাবণ), শরৎ ( ভাদ্র, আশ্বিন), হেমন্ত (কার্তিক, অগ্রহায়ণ), শীত (পৌষ, মাঘ), এবং বসন্ত (ফালগুন, চৈত্র)।
বারোমাসের নাম রাখা হয়েছে নক্ষত্রের নামে। মাসের নামঃ বৈশাখ (বিশাখা), জ্যৈষ্ঠ (জ্যেষ্ঠা), আষাঢ় ( উত্তরাষাঢ়া), শ্রাবণ (শ্রবণা), ভাদ্র (পূর্বভাদ্রপদ), আশ্বিন (অশ্বিনী), কার্তিক (কৃত্তিকা), অগ্রহায়ণ (মার্গশীর্ষ, মৃগশিরা), পৌষ (পুষ্য), মাঘ (মঘা), ফালগুন (উত্তর ফালগুনী), চৈত্র (চিত্রা)।
সপ্তাহের দিন সংখ্যা
অন্যান্য ক্যালেন্ডারের মতো বাংলা ক্যালেন্ডারে সাত দিনে এক সপ্তাহ। গ্রহ নক্ষত্রের নামে নামকরণকৃত। যেমন : সোমবার (মুন বা চাঁদ), মঙ্গলবার (মারস্ বা মঙ্গলগ্রহ), বুধবার (মারকিউরি বা বুধগ্রহ) বৃহস্পতিবার ( জুপিটার বা বৃহস্পতিগ্রহ), শুক্রবার (ভেনাস বা শুক্রগ্রহ), শনিবার (সাটার্ন বা শনিগ্রহ) এবং রবিবার (সান বা সূর্য)।
বাংলা ক্যালেন্ডারে দিন শুরু ও শেষ হয় সূর্য ওঠার সময়কালে। তবে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে দিনের শুরু মধ্যরাতে।
পরিমার্জিত বাংলা পঞ্জিকা
১৯৬৬ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমীর তত্ত্বাবধানে ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে একটি বিশেষ কমিটি বাংলাদেশে (তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান) বাংলা ক্যালেন্ডার পরিমার্জন করেন। অন্যান্য ক্যালেন্ডারের মতো এতে ৩৬৫ দিনে এক বছর। সূর্যের চারদিকে একবার ঘুরে আসতে পৃথিবীর সময় লাগে ৩৬৫ দিন ৫ ঘন্টা ৪৭ সেকেন্ড। এই অমিলে সমতা আনতে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার প্রতি চার বছর অন্তর ফেব্রুয়ারী মাসে একটি অতিরিক্ত দিন যোগ করে। একে লীপ ইয়ার বলে। জ্যোতিষশাস্ত্রের ওপর নির্ভরশীল বাংলা ক্যালেন্ডারে এই অতিরিক্ত লীপ ইয়ারের সাযুজ্য ছিল না। বাংলা মাসগুলোর দৈর্ঘ ছিল ভিন্ন ভিন্ন। এই অসামঞ্জস্য মেটাতে ও আরও যথাযথ করতে বাংলা একাডেমীর প্রস্তাবনা এরকমঃ
* বছরের প্রথম পাঁচটি মাস, বৈশাখ থেকে ভাদ্র, গঠিত হবে ৩১ দিনে।
* বছরের বাকি সাতটি মাস, আশ্বিন থেকে চৈত্র, গঠিত হবে ৩০ দিনে।
* গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের প্রতি লীপ ইয়ারে ফালগুন মাসে অতিরিক্ত একটি দিন যোগ হবে।
বাংলাদেশে, ১৯৮৭ সালে এই সংশোধিত বাংলা ক্যালেন্ডার সরকারীভাবে গৃহীত হয়। তবে, প্রতিবেশী ভারতের পশ্চিমবঙ্গে আগের ক্যালেন্ডারই অনসুরণ করা হয়। কারণ, এর সাথে রয়েছে হিন্দু সংস্কৃতির গভীর সংযোগ। হিন্দু ধর্মের আচার অনুষ্ঠানগুলো পালিত হয় চন্দ্রমাসের বিশেষ দিনগুলো ও বাংলা ক্যালেন্ডারের সমন্বয় সাধনের ওপর।
সংশোধিত ও অসংশোধিত সংস্করণ
বৈশাখ মাসের এক তারিখ বা পহেলা বৈশাখ বাংলা বছরের প্রথম দিন। পশ্চিম বাংলায় এটা পালিত হয় এপ্রিল মাসের ১৪ অথবা ১৫ তারিখে। বাংলাদেশে ক্যালেন্ডার সংশোধনের ফলে, নতুন বছরের দিনটি সবসময় এপ্রিলের ১৪ তারিখে পালিত হয়ে থাকে।
শান্তনু দত্ত (নাট্যকর্মী)